Wednesday, 18 May 2016

বাংলাদেশে শিল্প ও শিল্পায়ন

(সংকেত: ভূমিকা; বাংলাদেশের শিল্প ব্যবস্থা; বাংলাদেশের শিল্পনীতি; বিভিন্ন শিল্পসমূহ; বাংলাদেশের শিল্পের সমস্যা; শিল্পায়নের উপায়; উপসংহার।)
ভূমিকাঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প খাতের ভূমিকা অপরিসীম। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের জন্য ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন অপরিহার্য। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি মূলত সেই দেশের শিল্প ও শিল্পায়নের উপর নির্ভর করে। বিশ্বায়নের কারণে বর্তমান বিশ্ব-অর্থনীতি মুক্ত-অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। তাই প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার্থে শিল্পের অগ্রগতি অপরিহার্য।
বাংলাদেশের শিল্প ব্যবস্থাঃ বাংলাদেশের শিল্প কাঠামো অনুন্নত ও দুর্বল। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন পর্যন্ত ভঙ্গুর। ফলে শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়নি। শিল্প বলতে সাধারণত কারখানায় যন্ত্রপাতির সাহায্যে কাঁচামালকে চূড়ান্ত দ্রব্যে পরিণত করা বোঝানো হয়। উপযুক্ত কাঁচামাল, মূলধনের স্বল্পতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব শিল্পোয়নের পথে প্রধান সমস্যা বা বাধার সৃষ্টি করছে। তবে বর্তমানে শিল্প ব্যবস্থায় আগের চেয়ে অনেক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে শিল্প খাতের অবদান ৩১.৯৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের শিল্পনীতিঃ শিল্পায়ন বা শিল্প খাতকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসাবে বিবেচনা করে শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে ২০১১ সালে ‘শিল্পনীতি-২০১০’ ঘোষণা করা হয়। উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূলধারায় নারীদের নিয়ে আসা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ এ নীতির মূল উদ্দেশ্য। শিল্পনীতি ছাড়াও ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১১-২০১৫ এ সমৃদ্ধ ও আধুনিক শিল্পখাত গড়ে তোলার মাধ্যমে বেকারত্ব, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা বিধৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পসমূহঃ বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর একটি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২-১৩ অনুযায়ী এদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ৯২৩ মার্কিন ডলার। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ২২ মে প্রথম আলো’র হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ১১৯০ মার্কিন ডলার। এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অগ্রগতির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। নিম্নে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শিল্পসমূহ আলোচনা করা হলো-
পোশাক শিল্পঃ দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৩৫০০ এর বেশি কারখানা এবং ১৬ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছে যাদের ৬৬ শতাংশের বেশি নারী। বাংলাদেশ বিশ্বের ২০টির অধিক দেশে পোশাক রপ্তানি করছে। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয়। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন প্রথম। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে, যা মোট রপ্তানির ৫৬%। পোশাক শিল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তৈরি পোশাক শিল্প থেকে মোট রপ্তানি আয় ছকের মাধ্যমে নিম্নে দেখানো হলো-
সাল  ২০১০-১১  ২০১১-১২ ২০১২-১৩
রপ্তানি আয়  ৮৪৩২ মিলি. মার্কিন ডলার ৯৬০৩ মিলি. মার্কিন ডলার ১২০৪০ মিলি. মার্কিন ডলার
উৎসঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৩
পাট শিল্পঃ পাট বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। অতীতে প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসাবে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো পাট থেকে। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ লোক পাট চাষাবাদের কাজে এবং ২ লক্ষ শ্রমিক পাট শিল্পে নিয়োজিত আছে। পাটজাত দ্রব্যসমূহ হতে রপ্তানি আয় ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো-
সাল ২০১০-১১  ২০১১-১২ ২০১২-১৩
পাটজাত দ্রব্য ৭৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ৭০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ৪৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
কাঁচাপাট ৩৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ২৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার  ১৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
                 
উৎসঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৩
চিনি শিল্পঃ চিনি বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫টি চিনিকল আছে। বাংলাদেশের প্রধান চিনিকল হলো দর্শনার কেরু এন্ড কোং। দেশে বর্তমানে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৪.০০ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯৪,৭৪০ মেট্রিক টন চিনি বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়েছে।
চা শিল্পঃ চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি শিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫৮টি চা বাগান রয়েছে। চা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ১০৩টি কারখানা ও ২০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছে। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা চা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশের চা আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
কাগজ শিল্পঃ বাংলাদেশ কাগজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৫৩ সালে ‘কর্ণফুলী পেপার মিলস’ এর মাধ্যমে এদেশে কাগজ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, পাকশী কাগজ কল, আদমজী পার্টিকেল বোর্ড সহ অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন কাগজকল স্থাপিত হয়েছে। প্রতিবছর আমাদের দেশের কাগজ ও কাগজজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা অর্জিত হয়।
চামড়া শিল্পঃ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। চামড়া দ্বারা জুতা, ব্রিফকেস, হাতব্যাগ, শপিং ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, মানি ব্যাগ, হাত ঘড়ির ফিতা, বেল্ট ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়। ২০১৪ সালের ১৯ মে প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার প্রায় ২১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। কিন্তু চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে দশমিক ৪৬ শতাংশ দখল করতে পেরেছে। বাংলাদেশ যে সকল দেশে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি করে তার মধ্যে চীন, জাপান, ইতালি, ব্রাজিল, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য।
পর্যটন শিল্পঃ পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত। পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময় দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি বাংলাদেশ। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, হিমছড়ি ঝরনা, নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, জাফলং, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, লালবাগ কেল্লা, ষাটগম্বুজ মসজিদ, বরেন্দ্র জাদুঘর, প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থান। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী ২০০১ সালে বাংলাদেশে পর্যটকদের সংখ্যা ছিল ২,০৭,১৯৯ জন এবং ২০০৮ সালে এ সংখ্যা দাড়ায় ৪,৬৭,৩৩২ জন। ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ লোকের।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গ্রামের লোকেরা নিজগৃহে বসে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করে থাকে। যেমন হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে তৈরি করা হয় শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, বিছানার চাদর ইত্যাদি। মৃৎশিল্পের মধ্যে রয়েছে মাটির হাঁড়ি, কলস, পুতুল, ফুলদানি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে শিল্পের সমস্যাঃ কাঁচামাল, প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতা এবং সস্তা শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। বিরাজমান শিল্পের সমস্যার মধ্যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ আমলে এদেশের কাঁচামাল দ্বারা শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডে। পাকিস্তান আমলে যে কয়েকটি কারখানা ছিল তা স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সৈন্যদের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞে সেগুলো বিনষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের জনগণের মাথা পিছু আয় কম হওয়ার কারণে মূলধন গঠন সেভাবে হয়নি যা শিল্পায়নের পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসের ফলে বহু শ্রমিক নিহত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে। যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অন্যান্য শিল্পের উপর পড়তে পারে। তাছাড়া শ্রমিকের কারিগরি জ্ঞানের অভাব, খনিজ ও শক্তি সম্পদের অভাব, বৈদেশিক সাহায্যের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শিল্প ঋণের অভাব, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের শিল্প নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের উপায়ঃ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই। শিল্পায়নের ফলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অন্যতম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে উৎপাদনের প্রাণশক্তি বলা হয়। তাই এ খাতের উন্নয়ন জরুরি। তাছাড়া কারিগরি জ্ঞানে জনশক্তির জন্য কারিগরি বিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কৃষি কলেজ স্থাপন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা, অবকাঠামোর উন্নয়ন, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিদেশে বাজার সৃষ্টি, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে শিল্পায়নের পথ প্রশস্ত হবে।
উপসংহার: সর্বোপরি বাংলাদেশের শিল্প সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্প ব্যবস্থার উন্নতি হলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হবে। শিল্প সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে টেকসই শিল্প ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এতে শিল্প কাঠামো স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ লাভ করবে। যা আমাদের জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশ্বায়ন

(সংকেত: ভূমিকা; বিশ্বায়নের সংজ্ঞা; বিশ্বায়নের উৎপত্তি; বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য; বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য; বিশ্বায়নের কারণ; বিশ্বায়নের সুফল; বিশ্বায়নের কুফল; আমাদের করণীয়; উপসংহার।)
ভূমিকাঃ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে বিশ্বায়ন। যার মাধ্যমে বিশ্ববাসী তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে নিজেদের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছে। যার ফলে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাটি উঠে গিয়ে সমগ্র বিশ্ব একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। এ সম্পর্কে পল হারস্ট ও গ্রাহাম থমসন বলেন, 'Globalization has become a fashionable concept in the social sciences.'
বিশ্বায়নের সংজ্ঞাঃ ‘বিশ্বায়নের’ ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Globalization যা Globe শব্দ থেকে এসেছে। সাধারণভাবে বলা যায় বিশ্বায়ন হলো একটি প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মাঝে সমন্বয় সাধন হয়ে থাকে অথবা বিশ্বকে একীভূত করা হয়। বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Red wood বলেন, “Globalization is the creation of single world market”. আবার মার্টিন আলব্রো বলেন- ‘বিশ্বায়ন হলো সামগ্রিক কমিউনিটির মধ্যে সমস্ত মানুষকে নিয়ে আসার একটি প্রক্রিয়া।’ সুতরাং বলা যায় বিশ্বায়ন হচ্ছে সীমারেখাহীন বিশ্বব্যবস্থা, যার দ্বারা বিশ্বে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক তৈরি হয়ে থাকে।
বিশ্বায়নের উৎপত্তিঃ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বায়ন শব্দটির প্রচলন ঘটে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকের শেষ দিকে ‘ক্লাব অব রোম’ অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর পাশ্চাত্য মডেলের সীমাহীন প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যে ঘোষণা দেয় সেখান থেকেই মূলত বিশ্বায়নের সূত্রপাত হয়। যার মাধ্যমে আজ বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে একই বিশ্বসীমানা ও একই বিশ্ব সম্প্রদায়।
বিশ্বায়নের উদ্দেশ্যঃ বিশ্বায়ন ধারণার মূল উদ্দেশ্য হলো বাজার সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করা, সরকারি ব্যয় ও নিয়ন্ত্রণ হ্রাস এবং সরকারি সম্পত্তি ধারণার বিলোপ সাধন করে তা বেসরকারি আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়নের লক্ষ্য হলো স্নায়ুযুদ্ধের অবসান, পূর্ব-ইউরোপ ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যবস্থার উপর গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যঃ বর্তমান বিশ্বে বিশ্বায়ন প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে চলছে। এর কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-
- বিশ্বায়ন একটি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
- প্রযুক্তির দ্বারা বিশ্বায়ন নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
- বিশ্বায়ন একটি পরিবর্তনশীল বিষয়।
- বিশ্বায়ন নতুন কৌশলে নব্য উপনিবেশবাদের জন্ম দিয়েছে।
- বিশ্বায়ন সমস্ত বিশ্বের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে।
- বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে।
- বিশ্বায়ন উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
- একে অপরকে সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুলেছে অর্থাৎ FU, AU, ASEAN বিশ্বায়নের সৃষ্টি।
- বিশ্বায়নের চলার যে গতি তাতে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় না।
বিশ্বায়নের কারণঃ বিশ্বায়নের জন্য কোনো একক কারণ দায়ী নয় বরং এর পেছনে রয়েছে এক বা একাধিক কারণ। সেগুলো হলো -
তথ্য ও প্রযুক্তির বিকাশঃ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রধানতম কারণ হচ্ছে তথ্য ও প্রযুক্তির অবাধ বিকাশ। আর এ বিকাশের ধারাবাহিকতায় ঔপনিবেশিক আমল হতে প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপন করা হয়। এরপর রেডিও টেলিভিশন, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট প্রভৃতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের একটা সেতুবন্ধন তৈরি করা হয়।
সমাজতন্ত্রের পতনঃ নব্বই-এর দশকে সমাজতন্ত্রের পতন সংঘটিত হলে তার জায়গাটি দখল করে মূলত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আর এই শক্তির দ্বারাই পরবর্তীতে বিশ্বায়নের পথ প্রশস্ত হয়।
গণতন্ত্রের প্রসারঃ একটা সময় রাজতন্ত্রের জোয়ারের ফলে বিশ্বায়নের ধারণাটিই স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের অবাধ প্রসারের ফলে বিশ্বায়নের গতিও কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থাঃ পৃথিবীতে স্থায়ী বলতে কিছু নেই। এই সাধারণ নিয়মের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ঠিক একই সাথে বিশ্বায়নের বিকাশও ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বহুজাতিক সংস্থাঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা জন্ম নিয়েছে। যা বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। আর এ সমস্ত বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বায়নের পথ সহজ হয়েছে।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন স্পৃহা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা খারাপ অবস্থায় পতিত হয়। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য বিশ্বায়নকে স্বাগত জানায়।
বিশ্বায়নের সুফলঃ বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার বেশ কিছু সুফল রয়েছে যা নিম্মরূপ-
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়নঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে ইউরোপের দেশসমূহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক জোট গড়ার মাধ্যমে বিশ্বে সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশঃ বিশ্বায়নের ধারণার সাথে মুক্তবাজার অর্থনীতির সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলস্বরূপ বিশ্ববাজার ব্যবস্থার দ্বার সকলের কাছে উম্মোচিত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এখন মানুষের হাতের মুঠোয় এসেছে ই-কমার্স এর মাধ্যমে। এ ব্যবস্থায় বিশ্বের এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্তে ব্যবসায়ের কার্যাদি সম্পন্ন হচ্ছে।
বৃহদায়তন কর্মকান্ডের প্রসারঃ বৃহদায়তন বাজার ব্যবস্থার যে বিস্তার লক্ষ্য করা যায় তাতে বৃহৎ উৎপাদন ও বিপণন সহজসাধ্য হয়েছে। আর এটি মূলত বিশ্বায়নের সুফল। এতে একদিকে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে অন্যদিকে মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয়: বিশ্বায়নের ফলে যেমন বিশ্ব খুব কাছাকাছি এসে কাজ করছে ঠিক তেমনি উন্নত দেশসমূহের জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশ সহজে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যার দরুণ বিশ্বে জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয় সাধিত হচ্ছে।
যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নতিঃ বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বে যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ কথা সহজে বলা যায় যে, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে যোগাযোগ অধিক সহজতর। আবার তথ্যপ্রযুক্তিতে যে যতো উন্নত সে ততো উন্নয়ন করতে সক্ষম হচ্ছে।

বিশ্বায়নের কুফলঃ বিশ্বায়নের সুফলের পাশাপাশি এর কিছু কুফলও লক্ষ্য করা যায়। সেগুলো হলো-
অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধিঃ এক দেশের সাথে আরেক দেশের যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে তা মূলত বিশ্বায়নেরই ফল হিসেবে বিবেচিত হয়।
অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টিঃ বিশ্বায়নের ফলে যে দেশগুলো শিল্পে অনুন্নত সে দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে শিল্প কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে বেকারত্বের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয়ঃ উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থা অধিক উন্নত বিধায় অনুন্নত দেশ উপকৃত হওয়ার আশায় একদিকে যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থাও ধ্বংস হচ্ছে।
গোপনীয়তা রক্ষা কঠিনঃ ইন্টারনেট, ই-মেইল, ফ্যাক্স ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলোর গোপনীয় দলিল, সংবাদ ও তথ্য অতি তাড়াতাড়ি বিদেশি প্রতিপক্ষের হস্তগত হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক সংকটঃ বিশ্বায়নের দ্বারা সংস্কৃতি আজ চরমভাবে বিপর্যস্ত। ধনী দেশসমূহের অপসংস্কৃতির প্রভাবে গরীব বা অনুন্নত দেশের সংস্কৃতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
আমাদের করণীয়ঃ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশ্বায়নের এই তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে হবে। যথা-
- তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে উৎসাহমূলক কর্মকান্ড ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
- জনশক্তির কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।
- প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে শিক্ষিত বেকারদের কাজে লাগাতে হবে।
- সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের শাসনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহারঃ বিশ্বকে একই আয়নায় দেখার জন্য বিশ্বায়নের সৃষ্টি। বিশ্বায়নের কিছু নেতিবাচক প্রভাব বা কুফল থাকলেও এটি তার আপন গতিতে চলমান। তাই এর নেতিবাচক দিকগুলোর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে ইতিবাচক দিকগুলোর সুফল অর্জন করাই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর করণীয় হওয়া উচিত।

মানবাধিকার

(সংকেত: ভূমিকা; মানবাধিকারের ধারণা; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস; মানবাধিকার এবং বর্তমান বিশ্ব; মানবাধিকার ও উন্নয়ন; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সুফল; প্রতিবন্ধকতা; মানবাধিকার ও বাংলাদেশ; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও সংস্থাসমূহের ভূমিকা; বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম; উপসংহার।)
বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার ধারণাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে, তবে এই ধারণাটি সাম্প্রতিক বা নতুন নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালিত বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে মানবাধিকারের বিষয়টি খুঁজে পাওয়া যায়। হযরত মুহম্মদ (স.), যিশু খ্রীস্ট, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ মহামানবগণ ছিলেন মানবাধিকার ধারণার প্রবক্তা। বর্তমানকালেও মার্টিন লুথার কিং, মহাত্ম গান্ধী, মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ ব্যক্তিগণের মধ্যে মানবাধিকারের বিষয়টি স্বরূপে ভাস্বর।
মানবাধিকারের ধারণাঃ ১৯১৪ সালের ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর মানবাধিকারের বিষয়টি মানুষকে ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তোলে। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট নানা নৈরাজ্য, দুর্ভিক্ষ, হতাশা, অনাহার, নৈতিকতার অবক্ষয় প্রভৃতি অবস্থা উত্তরণের জন্য সমগ্র বিশ্বে একটি নীতির প্রয়োজন দেখা দেয়, যে নীতি দ্বারা বিশ্বের মানুষকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। এছাড়া পরবর্তীতে হিটলারের গঠিত ন্যাৎসী বাহিনীর অমানবিক অত্যাচার ও অনাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করার কথা ভেবেছিলেন তৎকালীন বিশ্বের কিছু মানুষ। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকার। মূলত মানবাধিকার মানে বোঝায়- ক্ষুধা থেকে মুক্তি, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষার সুযোগ লাভ, ব্যক্তিচিন্তার স্বাধীনতা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা, সকল অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমান উন্নতির নিশ্চয়তা প্রভৃতি।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসঃ মানবাধিকারের সার্বজনীন রূপটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৪ সালের ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। প্রতিষ্ঠিত হয় 'League of nations'. এটির উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন স্বায়ত্ত্বশাসিত কিংবা Trust Territory গুলোর মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধন করা। 'League of nations'-এর অঙ্গ সংগঠন ILO এর শ্রমিকের কর্মসময় ও পারিশ্রমিক নির্ধারণ করার মাধ্যমে মানবাধিকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯৪৪ সালে ওয়াশিংটনের Dumberton Oaks ভবনে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনায় Human Rights প্রসঙ্গটি স্থান পায়। ২৬ জুন, ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। সনদ অনুযায়ী মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ বা Fundamental human Rights হলো Dignity and worth of human Beings বা মানুষের মর্যাদা ও মূল্য, সমঅধিকার, ন্যায়বিচার, সামাজিক অগ্রগতি, মৌলিক স্বাধীনতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র বা Universal Declaration of Human Rights গৃহীত হয়। এইদিন ফ্রান্সে UDHR (Universal Declaration of Human Rights) ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের পত্নী মিসেস ইলিনর রুজভেল্ট। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকার।
মানবাধিকার এবং বর্তমান বিশ্ব: Universal Declaration of Human Rights যখন গৃহীত হয় তখন UNO’র সদস্য ছিল ৫৮। বর্তমানে ১৯৩টি দেশ UNOÕi সদস্য হয়েছে। আর এই সকল দেশই UNOÕi নীতিমালা মেনে চলার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। মানবাধিকার ঘোষণায় সকল ধর্ম বর্ণের এবং সকল জাতির সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানুষের মৌলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করারও অঙ্গীকার করা হয়।
UDHRÑ এর পথ ধরেই গৃহীত হয়েছে-
i) International convention on Civil and Political Rights.
ii) International convention of Economic, Social and Cultural Rights.
iii) Convention on the Rights of the Child.
iv) International convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women.  ইত্যাদি।
UNICEF, UNHCR, ILO, UNESCO, CEADAW ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসমূহ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্রের হিউমান রাইট ওয়াচ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
মানবাধিকার ও উন্নয়নঃ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৮৬ সালে গৃহীত এক প্রস্তাবে উন্নয়নকে মানবাধিকারের আওতাভূক্ত করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন ও মানবাধিকার এ দুটি ধারণা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত উন্নয়নকে জাতিসংঘ মানবাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে কিনা তার জন্য প্রয়োজন হবে-
i) মৌলিক জীবনধারণের অধিকার (Condition of life) যেমন-খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, অবসর ও বিনোদন প্রভৃতি সুযোগ ভোগ করার নিশ্চয়তা রয়েছে কিনা।
ii) Condition of Work অর্থাৎ চাকরি, আয় ইত্যাদির অধিকার আছে কিনা।
iii) Equality of Access of resources অর্থাৎ ভূমি, পুঁজি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ভোগ করছে কিনা।
iv) Participation বা স্থানীয়, জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত  কিনা।
এসবের হিসেবে UNDP, Human Development Index প্রকাশ করেছে এবং আয়ুষ্কাল, বয়স, শিক্ষা, আয় প্রভৃতি বিষয়গুলোকে উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
মানবাধিকারের সুফলঃ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পর অসংখ্য উদ্যোগ এবং কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে যা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। জনসাধারণের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার গুরুত্বকে বিবেচনা করে ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার শিক্ষা দশক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।
প্রতিবন্ধকতাঃ মানবাধিকার সমগ্র বিশ্বে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। তবুও এর কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মূলত বিশ্বে এখনো মানবাধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বের এক বিরাট জনগোষ্ঠী মানবাধিকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখন পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের জনগণের ক্ষুধা নিবারণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেনি। এখনো বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি অনেক দেশে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি পুরোপুরি সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
মানবাধিকার ও বাংলাদেশঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্মলগ্নের পরপরই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জনঅধিকারকে সংবিধানে স্থান দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত হয়েছে। ১০ই ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদার সাথে এখানে পালিত হয় মানবাধিকার দিবস। তবে মানবাধিকার পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি-এ দেশে। বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের ভাষ্যমতে ১৯৯৬ সালের নয় মাসে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে। পুলিশ ও জেলহাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, সড়ক ও নৌদুর্ঘটনা, যৌতুকপ্রথা, খুন-রাহাজানি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, সন্ত্রাস এখন বাংলাদেশের অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এসবই মানবাধিকার লংঘনের কারণ। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি আমাদের সাধারণ মানুষগুলোর জীবনকে বিপন্ন করে দিয়েছে। আবার নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দলীয় কোন্দল, হত্যা, গুম। এমতাবস্থায় এদেশে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, বিশৃঙ্খলামুক্ত সমাজ গঠন না করা গেলে, মানবাধিকার এখানে শুধু কথাতেই থেকে যাবে, কার্যে তা প্রকাশ পাবে না।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও সংস্থাসমূহের ভূমিকাঃ আশার কথা হলো বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা অন্যতম। সংবিধানে ২৬-৪৭ অনুচ্ছেদে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের স্বীকৃতি রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন NGO মানকবাধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। ৮০’র দশক থেকেই বেসরকারিভাবে তারা কার্যক্রম শুরু করেছে এদেশে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামঃ এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতির থাবা। সামরিকতন্ত্র, ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ, কালো টাকার দৌরাত্ম, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতির মধ্যেও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি পর্যায়ে প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুজন, আইন ও সালিস কেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়। সরকারিভাবে মানবাধিকার রক্ষায় ১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে বাংলাদেশ সরকার।
উপসংহারঃ গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতা, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ব নিয়েই দেশ ও বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত মানুষগুলোর চোখের পানি মুছে দিয়ে তাদের অধিকারকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য মানবাধিকার সংরক্ষণ একান্তভাবে জরুরি। তাহলেই সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি, সম্প্রীতি, এগিয়ে যাবে দেশ, এগিয়ে যাবে পৃথিবী আর মানব সভ্যতা।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী

(সংকেত: আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী; বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর পরিসংখ্যান; চাকমা; মারমা; তঞ্চঙ্গ্যা; গারো; রাখাইন; মনিপুরী; হাজং; সাঁওতাল; খাসিয়া; অন্যান্য; বর্তমানে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের অবস্থা; উপসংহার।)
বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং ভাষার দেশ। এদেশের বাংলা ভাষাভাষি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিদের পাশাপাশি সুদীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছে বেশ কিছু ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়। আচারে, অনুষ্ঠানে, ধর্মে, ভাষায়, সংস্কার-সংস্কৃতিতে এরা বাঙালিদের থেকে স্বতন্ত্র। এরা বাংলাদেশেরই অবিচ্ছেদ্য এবং অনিবার্য অংশ।
আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীঃ আদিবাসী এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Aborigines, শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Aborigine থেকে এসেছে যার অর্থ “শুরু থেকে” অর্থাৎ কোনো দেশে বসবাসরত আদিম জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলা হয়। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বলতে মূলত প্রধান জাতির পাশাপাশি বসবাসরত সংখ্যালগিষ্ঠ এবং অপেক্ষোকৃত অনগ্রসর জাতি বা সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর পরিসংখ্যানঃ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৯টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যাদের বেশিরভাগই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বাস করে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেখা গেছে বাংলাদেশে মোট আদিবাসীদের সংখ্যা ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭৫ জন। তবে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ৪৫টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এবং সর্বমোট ২০ লক্ষাধিক আদিবাসী আছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চাকমা, মারমা, রাখাইন, তঞ্চঙ্গ্যা, মনিপুরি, গারো, হাজং, সাঁওতাল, খাসিয়া প্রভৃতি নৃ-গোষ্ঠীগুলো। এরা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার প্রভৃতি অঞ্চলগুলোতে যুগ যুগ ধরে বাস করছে।
চাকমাঃ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ সম্প্রদায় হলো ‘চাকমা’। চাকমারা নিজেদেরকে বলে চাঙমা। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন প্রভৃতি জেলায় এদের বাস। এরা আবার ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এদের নিজস্ব সামাজিক, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা আছে যার প্রধান দায়িত্বে আছে রাজা। রাজাই চাকমাদের প্রথা, রীতি-নীতি নির্ধারণ, ভুমি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, গ্রামের কোন্দল এবং নানা সমস্যার নিষ্পত্তি করে। চাকমাদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। ফলে পুত্রসন্তানরাই কেবল পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে। কৃষি এদের প্রধান জীবিকা হলেও বর্তমানে চাকমারা চাকুরী ও ব্যবসাক্ষেত্রেও জায়গা করে নিয়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে চাকমাদের স্বাক্ষরতার হার (৩৭.৭%) সবচেয়ে বেশি। এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদের প্রধান প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলোর মধ্যে আছে মাঘী পূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্ণিমা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান, মধু পূর্ণিমা, ফানুস ওড়ানো প্রভৃতি। চাকমাদের অন্যতম বড় উৎসব হলো বিজু উৎসব।
মারমাঃ সংখ্যাগরিষ্ঠের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহৎ সম্প্রদায় হলো ‘মারমা’। পার্বত্য জেলাগুলোতে মারমাদের বসবাস দেখা গেলেও এরা মূলত বান্দরবনের অধিবাসী। মায়ানমার থেকে এসেছে বলে এদেরকে মারমা বলা হয়। তবে মারমা শব্দটি এসেছে ‘ম্রাইমা’ শব্দ থেকে। বান্দরবনে প্রায় ১ লাখ মারমা বাস করে। চাকমাদের মতো এদেরও সামজিক বিচার-আচারের দায়িত্ব রাজার হাতে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হলেও মারমা মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার লাভ করে। জুম চাষ, নদীর মাছ ও কাঁকড়া শিকার এবং কাপড়, চুরুট প্রভৃতি তৈরি করে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হয়ে এরা চাকুরী, ব্যবসাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। মারমারা নিজস্ব ভাষায় কথা বললেও লেখার ক্ষেত্রে বর্মিজ বর্ণমালা ব্যবহার করে। মারমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের মধ্যে আছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান, ওয়াগ্যোয়াই প্রভৃতি।
তঞ্চঙ্গ্যাঃ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যা উল্লেখযোগ্য। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় এদের বাস। তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের স্বতন্ত্র্য জাতি বলে দাবি করলেও নৃতাত্ত্বিকগণ মনে করেন এরা চাকমা জাতির একটি উপগোত্র। সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রথা, রীতি-নীতির দিক থেকে চাকমাদের সাথে এদের যথেষ্ট সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা ইন্দো-এরিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তঞ্চঙ্গ্যারা একে ‘মনভাষা’ বলে উল্লেখ করে।
গারোঃ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরের গভীর অরণ্য, অরণ্য সংলগ্ন এলাকা এবং গারো পাহাড়ের টিলায় বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী গারোদের বাস। এছাড়া নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে কিছু কিছু গারোদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। নৃতান্ত্রিকগণ মনে করেন এরা মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর একটি শাখা। গারোরা নিজেদের আচ্ছিক মান্দি অর্থাৎ পাহাড়ের মানুষ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। তবে যারা সমতলে বাস করে তারা কেবল মান্দি বলে পরিচয় দেয়। গারোদের সমাজ ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। গারোদের ভাষার নাম আচ্ছিক ভাষা। তবে সমতলে বসবাসকারী গারোদের ভাষা আলাদা, তাদের ভাষার নাম মান্দি ভাষা। গারোরা স্বতন্ত্র ধর্মমতে বিশ্বাসী আর তাদের সাংস্কৃতিক উৎসব, আচার-অনুষ্ঠানের মূলে রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস। গারোদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা উৎসব।
রাখাইনঃ রাখাইন সম্প্রদায় মূলত মায়ানমারের একটি জাতিগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অংশ, রাঙ্গামাটি ও বান্দবান জেলায় রাখাইনদের বাস। রাখাইনরা সাধারণত মগ নামে পরিচিত। রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। ফলে এদের প্রধান উৎসবগুলো হলো- বুদ্ধের জন্মবার্ষিকী পালন, বৈশাখী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা প্রভৃতি। এছাড়া রাখাইনরা সংক্রান্তিতে ৩ দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসব পালন করে অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণভাবে। পুরুষেরা লুঙ্গি, ফতুয়া আর নারীরা লুঙ্গি, ব্লাউজ, অলংকার এবং মাথায় ফুল পরিধান করতে পছন্দ করে। রাখাইনদের বিয়েতে পুরুষদের পণ দেওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে।
মনিপুরীঃ মনিপুরীদের আদি নিবাস ভারতের মনিপুর রাজ্যে। বার্মা-মনিপুর যুদ্ধের সময় এরা এসে বৃহত্তর সিলেটে আশ্রয় নিয়েছিল। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ময়মনসিংহেও মনিপুরীদের দেখতে পাওয়া যায়। ভাষাগত ও ধর্মীয় ভিন্নতার ফলে মনিপুরী সম্প্রদায় আলাদা আলাদা তিনটি উপ-গোষ্ঠীতে বিভক্ত। (১) বিষ্ণুপ্রিয়া, (২) মৈতৈ, (৩) পাঙন। ২০০৩ সালের এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ৪০ হাজার বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী এবং ১৫ হাজার মৈতৈ মনিপুরী আছে। মনিপুরীদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যাবাহী। বিশেষ করে মনিপুরী নৃত্য আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। মনিপুরীদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান হচ্ছে রাসপূর্ণিমা।
হাজংঃ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাজং সম্প্রদায়ের দেখা মেলে নেত্রকোনা জেলায়। হা মানে মাটি আর জং অর্থাৎ পোকা। প্রকৃতপক্ষে কৃষিকাজের সাথে সখ্যতার কারণে তাদের নাম দেওয়া হয়েছে হাজং। বাংলাদেশে প্রায় ৩০০০ হাজং এর বাস। হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন প্রভৃতি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে এরা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। হাজংদের নিজস্ব ভাষা আছে। হাজংদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘প্যাক খেলা’ উৎসব। এদের কিছু অংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং কিছু অংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ভাত, মাছ, সবজি ছাড়াও কচি বাঁশের গুড়া বা মিউয়া এদের প্রিয় খাবার।
সাঁওতালঃ পূর্বভারত ও বাংলাদেশের বৃহত্তম আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাঁওতাল। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে বিশেষত দিনাজপুর এবং রংপুরে সাঁওতালদের বাস। সাঁওতাল সম্প্রদায় আবার ১২টি উপগোত্রে বিভক্ত। এরা মাটির তৈরি ছোট ছোট ঘরে বাস করে। সাঁওতালদের প্রধান পেশা কৃষি। সাঁওতালদের প্রধান দেবতা বোংগা। এরা মূলত সূর্যের পূজা করে। সাঁওতালদের বার্ষিক উৎসবের নাম সোহরাই। এ উৎসবে সাঁওতাল মেয়েরা দলবেঁধে নাচে। সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য ভাত। এছাড়া মাছ, কাঁকড়া, শুকর, মুরগি, খরগোস, গুইসাপ, ইঁদুর এবং বেজির মাংস খেতে পছন্দ করে সাঁওতালরা। সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণে ইতিহাসে এরা বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
খাসিয়াঃ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে খাসিয়াদের বাস। মূলত ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন গভীর অরণ্যে থাকতেই পছন্দ করে এরা। বাংলাদেশে বসবাসকারী খাসিয়ারা সিনতেং গোত্রভুক্ত। খাসিয়ারা মূলত কৃষিজীবী। গভীর অরণ্যে এরা পান চাষ করে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে নারীরা বিয়ে করে বর নিয়ে আসে নিজের বাড়িতে। সম্পত্তির মালিকানাও নারীরাই লাভ করে।
অন্যান্যঃ আলোচিত সম্প্রদায়গুলো ছাড়াও বাংলাদেশে ত্রিপুরা, খিয়াং, মুন্ডা, চক, লুসাই প্রভৃতি আরো কিছু কিছু ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বসবাস করে থাকে।
বর্তমানে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের অবস্থাঃ অতীতে যদিও এই ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত, নিগৃহীত হতো কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে সরকার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের জন্য বিশেষ কোটা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা সহায়তাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রাগসর করে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো এখন কেবল কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে না বরং তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সম্মানজনক পদে চাকুরী করছে। এছাড়া ব্যবসা, রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্যে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
উপসংহারঃ বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলো এ দেশের নাগরিক। তাই তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। বর্তমানে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলে আরো ব্যাপক পরিসরে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, জীবনযাপন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন এবং এগুলো সংরক্ষণ করার যথাযথ ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

শব্দভাণ্ডার ও বাংলাশব্দের উৎস

শব্দভাণ্ডার ও বাংলাশব্দের উৎস

অর্থপূর্ণ ধ্বনি সমষ্টিই শব্দ। শব্দ আমাদের অতীতের কথা শোনায়। একদিন যা ছিল মানুষের মনে তা মুখে উচ্চারিত হয়ে শব্দরূপে ধরা দেয়। এক একটি নির্দিষ্ট সমাজ বলতে পারে কোন শব্দের কী মানে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন অভিজ্ঞতালব্ধ মৌলিক শব্দ, প্রত্যয়, উপসর্গ যোগে এবং সমাসের সাহায্যে নতুন নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরি করে যাচ্ছে। এক সময় যে শব্দ ছিল সবচেয় জনপ্রিয় কালের বিবর্তনে সে শব্দ হয়তো চির কালের জন্য হারিয়ে গেছে। আবার নতুন শব্দ কবি-সাহিত্যিক-গবেষকদের কল্যাণে নবরূপ পেয়েছে। এভাবেই গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেদিয়ে লক্ষাধিক শব্দ বাংলা ভাষার অভিধানে স্থান করে নিয়েছে। শব্দই ভাষাকে গতিময় করেছে তাই শব্দকে বলা হয় শব্দব্রহ্ম। ভাষার ক্ষুদ্রতম অংশ হলো ধ্বনি যা মুখের মাধ্যমে প্রকাশিত অর্থবহ আওয়াজ। এই অর্থবহ আওয়াজের লিখিতরূপ হলো বর্ণ। আর এই অর্থবহ বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে শব্দ বলে। এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থপূর্ণ মিলনই শব্দ।
বাংলা ভাষার অভিধানে যেসব শব্দ আছে অথবা যেসব শব্দ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে, মুখে ব্যবহার করে বা লিখে মনের ভাব প্রকাশ করে সেসব সঞ্চিত শব্দই শব্দভাণ্ডার নামে পরিচিত। যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত উন্নত সেই ভাষা তত সমৃদ্ধ। বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে আমাদের উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া শব্দ। যেগুলো অনেকটা পুরোনো শব্দ। ঋণকরা শব্দ এবং বিভিন্ন নিয়মের মাধ্যমে তৈরিকৃত শব্দ। দুটি উপায়ে শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করা সম্ভব। (১) শব্দের উৎপত্তি বা উৎস অনুসারে (২) শব্দের গঠন অনুসারে।
‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ বইতে বাংলা শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে বলা হয়েছে, কালে কালে বাংলা ভাষা নানা ভাষার সংস্পর্শে এসেছে। যে-সব ভাষার শব্দকে গ্রহণ করে এ ভাষা ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়েছে। এর শব্দভাণ্ডারও বেড়েছে। এদেশে মুসলিম শাসনামলে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। পরে ইংরেজ শাসনামলে এ ভাষায় গৃহীত হয়েছে অনেক ইংরেজি শব্দ। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার কিছু কিছু শব্দ স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। বাংলা কবিতায় অনুবাদের সূত্রেসংস্কৃতের ঋণ প্রথম থেকেই বিপুল ছিল, পরে উনিশ শতকের গদ্যে তা আরও প্রবল হয়।এছাড়া নানা ভাষা থেকে নানা সূত্রে কিছু কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশাধিকার পেয়েছে। বর্তমানে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার সূত্রে এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে অনেক নতুন নতুন শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে। এর ফলে ভাব প্রকাশের ক্ষমতা ক্রমেই বাড়ছে এবং তা অধিকতর সমৃদ্ধ হচ্ছে।
অস্ট্রিক ভাষা, দ্রাবিড় ভাষা, আর্য অর্থাৎ বৈদিক ভাষা, সংস্কৃত ভাষা (বৈদিক ভাষার সংস্কার), পালি ভাষা, প্রাকৃত ভাষা, অপভ্রংশ, আঞ্চলিক, প্রাদেশিক, বিদেশি ইত্যাদি ভাষার মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় এসেছে। উৎস অনুসারে শব্দভাণ্ডারকে কয়েকভাবে বৃদ্ধি করা যায়। যেমন:
১. সংস্কৃত শব্দ: যেসব শব্দ সংস্কৃতভাষা থেকে হুবহু বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের সংস্কৃত শব্দ বলে। এর বানান কোন পরিবর্তন হবে না। যেমন: গাত্র, কৃষ্ণ, মস্তক, হস্ত, কর্ণ, বৃক্ষ, মৎস্য, স্বর্ণ ইত্যাদি।
২. খণ্ডসংস্কৃত শব্দ: যেসব শব্দ সংস্কৃতভাষা থেকে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের খণ্ডসংস্কৃত শব্দ বলে। এর বানান সংস্কৃত শব্দ থেকে পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: গতর, কেষ্ট, গিন্নি, মাথা, হাত, কান, গাছ, মাছ, সোনা, উঠে, করছি, করছিলাম ইত্যাদি। আরো কিছু নমুনা:
সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত    সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত    সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত    সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত
সূর্য   সূয্যি       বৃষ্টি   বিষ্টি       ক্ষুধা  খিদে       জ্যোৎস্না     জোছনা
শ্রী    ছিরি       গ্রাম   গেরাম      নিমন্ত্রণ নেমন্তন্ন      শ্রাদ্ধ  ছেরাদ্দ
গৃহিণী গিন্নি       ঘৃণা   ঘেন্না       কর্ণ   কান       স্বর্ণ   সোনা
৩. তদ্ভব শব্দ : যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে প্রাকৃতভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলে। তদ্ভব শব্দের বানানে ঈ-কার হয়ে যায় ই-কার। ঊ-কার হয়ে যায় উ-কার। ণ-হয়ে যায় ন। য-ফলা থাকে না। যেমন: গা, ঘরনি, কানাই/কানু, বোশেখি, সুয্যি, সোনা, সন্ধে, পহেলা/পয়লা। কিছু তদ্ভব শব্দের নমুনা:
তদ্ভব শব্দ <সংস্কৃত শব্দ
অপরূপ < অপূর্ব
অমিয় < অমৃত
অলখ < অলক্ষে
আইচ < আদিত্য
আখড়া < অক্ষবাট
আঁখি < অক্ষি
আঁচল < অঞ্চল
আজ < অদ্য
আঁটি < অস্থি
আড়াই < অর্ধতৃতীয়
আদিখ্যেতা < আধিক্যতা
আন্ধার < অন্ধকার
আপন < আত্মপন
আমড়া < আম্রাতক
আমি < অস্মাভি
আরশি < আদর্শিকা
আলতা < অলক্তক
আশি < অশীতি
আঁশ < অংশু
আষ < আমিষ
আস্তাবল <stable
আনারস <Ananos
আলমারি < Armario
ইট < ইষ্টক
ইঁদারা < ইন্দ্রাগার
উন্মনা < উৎমনা
উনুন < উষ্মাপন
উবু < ঊর্ধ্ব
এগার < একাদশ
এয়ো < অবিধবা
ওঝা < উপাধ্যায়
কনে < কন্যা
কনুই < কফনিকা
কলা < কদলি
কাছাড়ি < কৃত্যগৃহ
কাঁথা < কন্থা
কাঁদন < ক্রন্দন
কানু < কৃষ্ণ
কাম < কর্ম
কামার < কর্মকার
কাহন < কার্যাপন  
তদ্ভব শব্দ <সংস্কৃত শব্দ
কুমার < কুম্ভকার
কুঁড়ি < কোরক/কমডল
কেয়া < কেতকী
খই < খদিকা
খাজা < খাদ্য
খুদ < খুদ্র
খেয়া < ক্ষেপ
গরজে < গর্জে
গা < গাত্র
গাঁ < গ্রাম
গাং < গঙ্গা
গাজন < গর্জন
গামছা < গামোছা
গারদ < Guard
গুয়া < গুবাক
গোলাপ < গুলো+আব (ফা.)
গোয়াড়ি < গোপবাটিকা
ঘর < গৃহ
ঘরনি < গৃহিণী
চাকা < চক্র
চিড়া < চিপিটক
চৌকা < চতুঙ্ক
ছা < শাবক
জাঁদরেল < General
ঝি < দুহিতা
ঠাঁই < স্থানিক
ঠোঁট < তুণ্ড
দেউটি < দীপবর্তিকা
দুয়ার < দ্বার
দেরাজ < Drawer
নতুন < নূতন
নিশ্চুপ < নিশ্চল+চুপ
পরশে < স্পর্শে
পরান < প্রাণ
পয়লা < প্রথমিল
পাখা < পক্ষ
পুষ্পারতি < পুষ্প+আরতি
পেঁপে < পাপাইয়া (পর্তু)
পোলা < পোতক
ফিরিঙ্গি < Frank
বাঁদর < বানর
তদ্ভব শব্দ <সংস্কৃত শব্দ
তদ্ভব শব্দ সংস্কৃত
বুক < বক্ষ
বুনো < বন্য
বেহুলা < বিপুলা
বোঁচকা < বোগচা (তুর্কি)
বোঁটা < বৃন্ত
ভাত < ভত্ত
ভালো < ভদ্রক
মঞ্চ < মর্ত্য
ময়দা < সেমিদালিস
মাইরি < mary
মাছ < মৎস্য
মাঝ < মধ্য
মাটি < মৃত্তিকা
মাথা < মস্তক
মিনতি < মিন্নত (ফা.)
মেজো < মধ্যক
মোছ < মচ্ছু <শ্মশ্রু
রাখাল <রক্ষপাল
লাট < Lord
শিউলি < শেফালিকা
সতীন < সপত্নী
সঁপা < সমর্পণ
সমঝোতা < সমঝৌতা
সরগ < স্বর্গ
সাঁই < স্বামী
সাঁওতাল < সামন্তপাল
সাঁকো < সংক্রম
সাত < সপ্ত
সাপ< সর্প
সায়র < সাগর
সিঙ্গারা < শৃঙ্গটাক
সিঁথি < সিমন্তিকা
সুন্দর < সুনর
সেজো < সিহ+জ (ফা.)
সেয়ানা < সজ্ঞান
সোনা < স্বর্ণ
সোহাগ < সৌভাগ্য
হাঁটা < হণ্টন
হালকা < লঘুক
গেন্ডারিয়া <Grand Area

৪. আঞ্চলিক শব্দ : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত শব্দকে আঞ্চলিক শব্দ বলে। যেমন: হাত>ড্যানা, ষাঁড়>হাঁড় ইত্যাদি।
৫. দেশি শব্দ : যেসব শব্দ বাংলার আদিবাসীদের (যারা অনার্য যেমন: কোল, মুন্ডা) ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় রক্ষিত আছে তাদের দেশি শব্দ বলে। যেমন: কুলা, চুলা, কুড়ি, পেট ইত্যাদি।
৬. প্রাদেশিক শব্দ : সংস্কৃত বাদে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ভাষা থেকে আগত শব্দকে প্রাদেশিক শব্দ বলে। এর বানান পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রাদেশিক শব্দ ব্যবসা, বাণিজ্য, মিডিয়ার বদৌলতে বাংলা ভাষায় নিজস্ব স্থান দখল করে চলেছে। তারমধ্যে হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি উল্লেখযোগ্য। যেমন:
হিন্দি শব্দ    : কাহানি>কাহিনি, ঠান্ডি>ঠান্ডা, পহেলা, দোসরা, ঠিকানা
পাঞ্জাবি শব্দ   : শিখ, চাহিদা
গুজরাটি শব্দ : হরতাল, খদ্দর
মারাঠি শব্দ   : চৌথ বর্গি
সাঁওতালি শব্দ : হাড়িয়া, কম্বল
তামিল শব্দ   : খুকি, কলা/Art, গুরুট>চুরুট
৭. বিদেশি শব্দ : বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষী মানুষের মাধ্যমে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের বিদেশি শব্দ বলে। বিদেশি শব্দে সবসময় ই/উ-কার বসে ঙ/ছ/ঞ্জ/ঞ্চ/ণ/ণ্ট/ণ্ড/ষ্ট না বসে ং/স/শ/নজ/ নচ/ন/ ন্ট/ন্ড/স্ট বসে। যেমন: আল্লাহ, ফেরেস্তা, স্কুল/কলেজ, আঁশ, জানালা, সাবান, টেক্কা, কাঁচি, লাশ, চা, চিনি, রিকশা, লুংগি, ডেংগু, ঝান্ডা, লন্ঠন, মিসরি, পসন্দ, তির (ধনুক), ইনজিনিয়ার, সেনচুরি, ব্যাংক, ইনজিন, এন্ড, খ্রিস্টার্ন, স্টল, স্টেশন, স্টোর।
বিদেশি বা অন্যভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় আগত শব্দকেই বিদেশি বা আগন্তুকশব্দ বলে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সেমিটিক/পহলবি (ফারসি) ভাষা থেকে আগত শব্দগুলো ইসলামি সংস্কৃতির শব্দ বলা হয়। এ শাখায় রয়েছে আরবি ফারসির তুর্কি ভাষার শব্দ। বাংলা ভাষায় এসবশব্দের প্রবেশের কারণ ছিল মুসলমান শাসন। তেরশতক থেকে আঠারশতক পর্যন্ত ফারসি রাজভাষা থাকার কারণে ফারসি শব্দ এবং ফারসি শব্দের আশ্রয় নিয়ে আরবির তুর্কি শব্দ প্রবেশ করে। বাংলা ভাষায় প্রায় আড়াই হাজারের মতো আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ রয়েছে। পুরোনো বাংলায় এসব শব্দ না থাকলেও মধ্যযুগ থেকে এসব শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। কিছু বিদেশি শব্দের নমুনা:
তুর্কি শব্দ         : চাকু, চাকর, তোপ-দারোগা/তুর্কি বলে ধার ধারোগা।
ইংরেজি শব্দ       : ইংরেজি শব্দ দুপ্রকার।
অনেকটা ইংরেজি উচ্চারণে: ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, কলেজ, টিন, নভেল, নোট, পাউডার, পেন্সিল, ব্যাগ।
পরিবর্তিত উচ্চারণে   : পরিবর্তিত উচ্চারণে অনেক শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন: গুদাম, পাউরুটি।
চিনা শব্দ         : চা, চিনি, লিচু।
জাপানি শব্দ       : রিকশা, হারিকিরি, হাসনাহেনা।
বর্মি শব্দ         : লুংগি, ফুংগি।
৮. পারিভাষিক শব্দ : বিশেষ অর্থ প্রকাশের জন্য ইংরেজি থেকে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের পারিভাষিক শব্দ বলে। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলা ভাষার প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে। যেমন:
পাঠ্যসূচি—syllabus, আইন—act, অম্লজান—oxygen, উদযাপন—hydrogen, নথি—file, প্রশিক্ষণ— training, ব্যবস্থাপক—manager, বেতার—radio, মহাব্যবস্থাপক—general manager, সচিব— secretary, স্নাতক—graduate, স্নাতকোত্তর—post greduate, সমাপ্তি—final, সাময়িকী—periodical, সমীকরণ— equation। উপরের ৮ প্রকার ছাড়াও আরো কিছু শব্দ মৌখিকভাবে তৈরি হয়েছে যা সাধিতশব্দ। যেমন: গুলমারা, গ্যাজানো।

শব্দদ্বিত্ব /দ্বৈতশব্দ /দ্বিরুক্তি

শব্দদ্বিত্ব দিয়ে আমরা সম্ভাব্য, বহুবচন ও অনুকার বুঝাতে ব্যবহার করি। বিশেষ অর্থ প্রকাশের জন্য যেসব শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয় তাদের দ্বিরুক্তি বা দ্বৈতশব্দ বা শব্দদ্বিত্ব বলে। যেমন: আমার জ্বর হয়েছে এবং জ্বর জ্বর লাগছে এক অর্থ নয়। জ্বর থেকে জ্বর জ্বর, বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে থাকে। কথাকে সুন্দর ও ছন্দময় করতে, বাক্যের বিশেষ অর্থ দিতে শব্দদ্বিত্বের বিশেষ দরকার। অনুভূতির ধ্বনির সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি শব্দ দিয়ে একটি বিশেষ অর্থবোধক শব্দ বানানো যায়। আবার ধ্বনাত্বকজাতীয় একই শব্দ দুবার বসিয়ে বিশেষ অর্থ প্রকাশের জন্য যেসব শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয় তাদের দ্বিত্বশব্দ বলে। শব্দদ্বিত্ব দিয়ে শব্দ গঠন করা যায়। শব্দদ্বিত্বকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
১. শব্দদ্বিত্ব : বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে শব্দে দুবার ব্যবহৃত হয়। যেমন: ভাল ভাল ফল, ছোট ছোট ঘর, বিন্দু বিন্দু জল, লালনপালন, বকাঝকা, লেনদেন, ধনী গরিব।
২. পদদ্বিত্ব : বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে পদ দুবার ব্যবহৃত হয়। যেমন: বর্তমানে ঘরে ঘরে শিক্ষিত। মনে মনে বলি, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।
৩. অনুকার দ্বিত্ব : যেসব অনুভবপ্রধান শব্দ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে দুবার ব্যবহৃত হয়। যেমন: শাঁইশাঁই, পনপন, ঝনঝন, মিউমিউ, ঝিকঝিক, টপাটপ, বকবকানি।

দ্বিত্বশব্দ গঠনপদ্ধতি
বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে দ্বিত্ব শব্দ গঠন করা যায়। যেমন:
১. বিশেষ্য+বিশেষ্য               = দিন দিন, বাড়ি বাড়ি
২. বিশেষণ+বিশেষণ              = ছোট ছোট, ভালো ভালো
৩. সর্বনাম + সর্বনাম            = কে কে, সে সে
৪. অসমাপিকাক্রিয়া + অসমাপিকাক্রিয়া = হাসতে হাসতে, যেতে যেতে, হেসে হেসে
৫. যোজক + যোজক            = ছি ছি, টন টন, টাপুর টুপুর

দ্বিত্বশব্দের নিয়ম
১. বিশেষ্য শব্দের দ্বিত্ব: এরা সমার্থক, প্রায় সমার্থক ব্যতিহার, অনুকার বা বিপরীত হতে পারে। যেমন: কবি কবি, দিন দিন, বাড়ি বাড়ি, লোকে লোকে, দ্বারে দ্বারে, সঙ্গি-সাথি, রাশিরাশি, ছোট বড়, সুখদুখ, আলো-আঁধার, ওঠা-বসা, আকাশে-বাতাসে, দলে-বলে, থেকে থেকে, হাড়ে হাড়ে, ফাঁকে ফাঁকে, পথে পথে, পাতায় পাতায়, সময় সময়, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, দিনে দিনে, পিছে পিছে, পাশে পাশে, উপরে উপরে, পাছে পাছে, সারিসারি, ধামাধামা, জ্বরজ্বর, মাথামুণ্ডু, বাড়িঘর, কলকারখানা, ধনদৌলত, উল্টাপাল্টা, হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব, হেসেখেলে, নেচেগেয়ে, পড়েশুনে, বারবার, আগাগোড়া, রেগেমেগে, ধনী গরিব, গল্পস্বল্প, রকমসকম, দেনাপাওনা, টাকাপয়সা, ভাতটাত, চালচলন, ডালভাত, তালাচাবি, পথঘাট, বনজঙ্গল, অলিগলি, জারিজুরি, ভয়েভয়ে, হাটেহাটে, হাতেনাতে, চোখেচোখে, মুখেমুখে, গল্পস্বল্প ইত্যাদি।
২. বিশেষ্য/বিশেষণ শব্দে দ্বিত্ব: অনেক সময় কবিগণ দুটি বিশেষ্য ব্যবহার করেন যা ত্রুটিপূর্ণ বলে অনেকেই সমালোচনা করেন। কিন্তু কবি যদি তাঁর ব্যবহৃত দুটি শব্দের প্রথম বিশেষ্য দিয়ে বিশেষণ এবং দ্বিতীয় বিশেষ্য দিয়ে বিশেষ্য বুঝাতে পারেন তাহলে ব্যবহার ত্রটিপূর্ণ হবে না। যেমন: তনুর দেহ একই অর্থ অর্থাৎ শরীর অর্থ বহন করে তবে এখানে তনু— নমুনীয়/কমনীয় /সরু অর্থ প্রকাশ করছে। শুভ্রশাদা। শুভ্রর শাদা একই অর্থ বহন করে তবে এখানে শুভ্র— ধবধবে/অতিশয় শাদা/উজ্জ্বল অর্থ প্রকাশ করছে। কিন্তু অশ্রুজল দিয়ে তেমন বোঝায় না। অশ্রু অর্থ চোখের জল কিন্তু অশ্রু দিয়ে জলের কোন বিশেষণ প্রকাশ করছে না।
৩. সর্বনাম শব্দে দ্বিত্ব: যারা যারা, কে কে, সে সে, কেউ কেউ ইত্যাদি।
৪. যোজক অনুকার বা ধ্বনাত্মক শব্দে দ্বিত্ব: এসব নিরর্থক শব্দ অর্থবোধক হয়ে যায় ব্যবহারের পর। যেসব যোজক বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে দুবার ব্যবহৃত হয়ে ধ্বনি সৃষ্টি করে তারাই অনুকার যোজক । বকবকানি। আবার এসব শব্দের মাঝে আ-কারের আগমন ঘটে। শূন্যতা, রং বা বর্ণের স্বরূপ, শরীরের অনুভূতি, গতি, দ্বীপ্তি ইত্যাদি বুঝাতে এসব শব্দ দুবার ব্যবহার করা হয়। এগুলো আবার নিচের ভিন্নভিন্ন অর্থে প্রকাশ পেতে পারে। যেমন: শরীরে অনুভূতি: যখন যখন, সহচর-অনুচর, বন্ধু-বান্ধব, হায় হায়, ছি ছি, বারবার ইত্যাদি। কুহুকুহু, কা কা, ঠাঠা, কুটকুট, কিটকিট, কুচকুচ, কুচকুচে, ক্যাঁচক্যাঁচ, কিচিরমিচির, খলখল, খচখচ, খিলখিল, খিটমিট, খপখপ, গমগম, গরগর, ঘরঘর, ঘুটঘুটে, গাপুসগুপুস, টনটন, ঠনঠন, ডংডং, ডিমডিম, ঢংঢং, টাপুরটুপুর, টংটং, টুকটুক, টুকটুকে, মিটিরমিটির, টকটক, চটচট, চিকচিক, ছমছম, ছলছল, ঝিঝি, ঝনঝন, ঝিকঝিক, ঝিরঝির, ফুরফুরে, পনপন, মিউমিউ, মচমচ, মটমট, মড়মড়, মিটমিট, মিনমিন, পিটপিট, থমথম, ধবধব, সিরসির, ফড়ফড়, ভেউভেউ, ভড়ভড়, বকরবকর, বড়বড়, খনখন, পড়পড়, চকচক, ফটফট, বজরবজর, বিড়বিড়, ব্যাজব্যাজ, ফকফক, খকখক, বকবক, বনবন, ভনভন, ভ্যানভ্যান, রিমঝিম, রুনুঝুনু, রিনিঝিনি, শাঁইশাঁই, হনহন।
আবার মাঝে স্বরকার যুক্ত হয়: ধপধপ>ধপাধপ, টপাটপ, গপাগপ, সপাসপ, পটাপট, ফটাফট, খটাখট, ছলাছল, ঝটাঝট, বকবকানি, ছটফটানি, ঝমঝমানি, চুপচাপ, ছলছলিয়ে, কলকলিয়ে, ঝনঝনিয়ে, খিটমিটিয়ে, খপখপাৎ/খপখপিয়ে, চটচটিয়ে, কুলুকুল, খচাখচ, ছমছম, চটপটে, চিনচিন, কটকট, কুটকুট, কনকন, চটপটে ইত্যাদি। আঁকুপাঁকু, হীনহীন, ছটফট, ধুকধুক, টনটন, ম্যাজম্যাজ, পিনপিন রিরি, সুড়সুড় ইত্যাদি।
গতি: খটখট, গটগট, ঘটঘট, থপথপ, ধপধপ, ধপাসধপাস, শাঁশাঁ, হনহন, পনপন, ভনভন, ফিসফিস, পতপত, ফতফত, দুমদুম, ধুমধুম, ধামধাম, দ্রুমদ্রাম, ঠাসঠাস, ঝপাতঝপাত, ঢকঢক, দুপদুপ, ফোঁসফোঁস ইত্যাদি। শূন্যতা: ধুধু, খাঁখাঁ, থইথই, ঝাঁঝাঁ, হাঁহাঁ ইত্যাদি।  রঙ/বর্ণ: ফুটফুটে, কুচকুচে, ধবধবে, দগদগে, রগরগে, চটচটে। দীপ্তি: জ্বলজ্বল, ঝকঝক, ঝলমল, ঝিলিমিলি, ঝিকমিক।
৫. সমাপিকাক্রিয়ার দ্বিত্ব: আসা-যাওয়া, লেনদেন, বকাঝকা, খেলাধুলা, লালন-পালন, খোঁজ-খবর, যায়যায়।
৬. অসমাপিকাক্রিয়ার দ্বিত্ব: হাসতে হাসতে, যেতে যতে, হেসেহেসে, দেখতে দেখতে, দেখেদেখে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, ডেকেডেকে, মারামারি, হাতাহাতি, জেদাজেদি, ছটফট, নিশপিশ, হেঁটেহেঁটে, খেয়েখেয়ে, নেচেনেচে, কেঁশেকেঁশে, ভেসেভেসে।
৭. ক্রিয়াবিশেষণের দ্বিত্ব : ধীরে ধীরে, ফিরে ফিরে, আস্তে আস্তে ইত্যাদি।

শব্দগঠনের উপায় (সন্ধি)

বিভিন্নভাবে সন্ধিকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যেমন: সন্ধি অর্থ মিলন অর্থাৎ পাশাপাশি দুই বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে। অথবা বর্ণকে আশ্রয় করে অর্থপূর্ণ দুটি শব্দকে যে সূত্রে একশব্দ করা হয় তাকে সন্ধি বলে। অথবা প্রথম শব্দের শেষবর্ণ এবং দ্বিতীয় শব্দের প্রথমবর্ণ মিলে নতুন শব্দ তৈরির প্রক্রিয়াকে সন্ধি বলে। অথবা উচ্চারণের সময় কাছাকাছি দুবর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে। অথবা বর্ণ সংযোগে বা লোপে নতুন অর্থবোধক গঠিত শব্দকে সন্ধি বলে। অথবা বর্ণকে আশ্রয় করে অর্থসংগতিপূর্ণ দুটি শব্দকে একশব্দে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে সন্ধি বলে। সন্ধি মিলন, বিকৃত ও লোপেও হয়ে থাকে। যেমন : মিলন (প্রথম শব্দে শেষ বর্ণ এবং দ্বিতীয় শব্দের প্রথম বর্ণ): বিদ্যা +আলয়=বিদ্যালয়। বিকৃতি (পূর্ব বর্ণের বা পরের বর্ণের বিকৃতি): উৎ+চারণ=উচ্চারণ, যাচ +না =যাচঞা। লোপ (পূর্ব বর্ণের বা পরের বর্ণের বিকৃতি): অতঃ+এব=অতএব, উৎ+স্থান =উত্থান /ইতি+আদি =ইত্যাদি, ইতি+মধ্যে =ইতোমধ্যে।

ব্যাকরণবিদগণ বিভিন্নভাবে সন্ধির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যেমন :
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বর্ণদ্বয়ের মিলনকে সন্ধি বলে।
ড. সুকুমার সেন    : পরস্পর অত্যন্ত সন্নিহিত দুই বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক: একাধিক ধ্বনির মিলন, লোপ বা পরিবর্তনের নাম সন্ধি।
অশোক মুখোপাধ্যায়   : একান্ত সন্নিহিত বা অব্যবহিত দুটি ধ্বনির মিলনের নাম সন্ধি।
জ্যোতিভূষণ চাকী    : দ্রুত উচ্চারণের ফলে পরস্পর সন্নিহিত ধ্বনির পরিবর্তন হয়।
                 এতে দুটি ধ্বনির মিলন, পরিবর্তন কিংবা লোপ হতে পারে। এরূপ মিলন
                 বা লোপ বা পরিবর্তনকে সন্ধি বলে।
সন্ধির উপাদান
সন্ধি নিয়মের কয়েকটি উপাদান রয়েছে। যেমন : ধ্বনি ও বর্ণ, পূর্বপদ অর্থাৎ প্রথম শব্দ, পরপদ/উত্তর শব্দ অর্থাৎ দ্বিতীয় শব্দ।

সন্ধির কাজ বা সন্ধির প্রয়োজনীয়তা
সন্ধির কাজ হলো উচ্চারণ ঠিক রাখার নতুন শব্দ গঠন করা। ভাষার জন্য সন্ধির ব্যবহার খুব প্রয়োজন। যেমন: সন্ধি ভাষাকে শ্রুতিমধুর, প্রাঞ্জল ও সংক্ষিপ্ত করে, উচ্চারণ ও বানান শুদ্ধ ও সঠিক করে, দুটি বর্ণে মিলন, বিকৃত ও লোপ ঘটিয়ে একটি বর্ণের মাধ্যমে নতুন শব্দ গঠন করে এবং শব্দের অর্থের পরিবর্তন ও বিস্তার ঘটায়।
শব্দ উচ্চারণের সুবিধার্থে এবং ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সন্ধির উদ্ভব হয়েছে। সন্ধির জন্যই দুটি শব্দ একসঙ্গে উচ্চারণ করা যায়। সাধারণত দুটি বর্ণের মিলনে সন্ধি হয় তবে বিকৃতি বা লোপেও সন্ধি হয়। আবার সকল ক্ষেত্রে সন্ধি হয় না। যেমন: অর্থ+ অভাব= অর্থাভাব, দুর+অবস্থা=দুরাবস্থা, মান+অভিমান =মানাভিমান ইত্যাদি।
নামের ক্ষেত্রেও সন্ধির সুবিধা নেয়া হয়। যেমন শরৎ+চন্দ্র=শরৎচন্দ্র /শরচ্চন্দ্র, রবি+ইন্দ্র =রবীন্দ্র। তবে সন্ধিজাত বা সমাসজাত নামবাচক শব্দ একশব্দ হয় তা আগের লেখকগণ করতেন না তবে বর্তমানে করা হয়। যেমন: রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, পরমেশ প্রসন্ন, বসন্ত কুমার।

সন্ধির প্রকার
বিভিন্নভাবে সন্ধির প্রকরণ দেখানো যায়। যেমন:
উৎপত্তিগত
গঠনগত
অনিয়মগত
১. সংস্কৃত সন্ধি
সংস্কৃত শব্দ+সংস্কৃত শব্দ
২. দেশি সন্ধি
দেশি শব্দ + দেশি শব্দ
সংস্কৃত ও দেশি শব্দের
মিলনে সন্ধি হয় না
১. স্বরসন্ধি
২. ব্যঞ্জনসন্ধি
৩. বিসর্গসন্ধি
স্বরসন্ধি বা ব্যঞ্জনসন্ধি
দুটির ক্ষেত্রেই হতে পারে—
১. অন্ত সন্ধি
অসমবর্ণের মিলনে তৈরি—
নৌ+ইক=নাবিক,
ভজ+ক্ত =ভক্ত
২. বহিঃসন্ধি
সমবর্ণের মিলনে তৈরি-মহা
+আশয়=মহাশয়
নিপাতনে সন্ধি:
কিছু সন্ধিজাত শব্দ সন্ধির প্রকৃত নিয়ম না মেনে তৈরি হয় বলে তাদের নিপাতনে সন্ধি বলে। যেমন:
১. স্বরনিপাতনে সন্ধি
গো+অক্ষ = গবাক্ষ
২. ব্যঞ্জননিপাতনে সন্ধি
পর+পর = পরস্পর


সন্ধি বিভিন্ন প্রকার। যেমন :
১. স্বরসন্ধি: স্বরবর্ণ ও স্বরবর্ণের মিলনে যে সন্ধি হয় তাকে স্বরসন্ধি বলে। যেমন: নর+অধম= নরাধম।
২. ব্যঞ্জনসন্ধি  : স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ অথবা ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরবর্ণ অথবা ব্যঞ্জনবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মিলনে যে সন্ধি হয় তাকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে। যেমন: পরি+ছদ=পরিচ্ছদ, দিক+অন্ত=দিগন্ত, উৎ+ লাস =উল্লাস।
৩. বিসর্গসন্ধি (ঃ উঠে যায়): বিসর্গবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মিলনে যে সন্ধি হয় তাকে বিসর্গসন্ধি বলে। সাধারণত ‘র’ ও ‘স’-এর সংক্ষিপ্ত রূপকে বিসর্গ সন্ধি বলে। যেমন: ততঃ+অধিক=ততোধিক, মনঃ+ রম=মনোরম, অন্তঃ>অন্ত, নমঃ>নমস।
৪. নিপাতনে সন্ধি    : নিয়মহীনভাবে যে সন্ধি হয় তাকে নিপাতনে সন্ধি বলে। যেমন: গো+অক্ষ=গোঅক্ষ বা গোবক্ষ বা গোবাক্ষ না হয়ে হবে গবাক্ষ, এখানে ‘ব’ না থাকা শর্তেও ‘ব’ এসেছে। দুভাবে নিপাতনে সন্ধিকে ভাগ করা যায়। যেমন:
ক) স্বরনিপাতনে সন্ধি: নিয়মহীনভাবে স্বর ও স্বর সন্ধির মিলনে যে সন্ধি হয় তাকে স্বরনিপাতনে সন্ধি বলে। যেমন: অন্য+অন্য= অন্যান্য, আইন+অনুসারে=আইনানুসারে।
খ) ব্যঞ্জননিপাতনে সন্ধি: নিয়মহীনভাবে ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জন সন্ধির মিলনে যে সন্ধি হয় তাকে ব্যঞ্জননিপাতনে সন্ধি বলে। যেমন: এক+দশ=একাদশ, তৎ+কর=তস্কর, পর+পর= পরস্পর, বন+পতি=বনস্পতি।

স্বরসন্ধির ব্যবহার বা বিচ্ছেদ
১. আ (া )
অ +অ =আ  : নরাধম (নর +অধম), নবান্ন, পলান্ন, হিতাহিত, শশাঙ্ক, হিমাচল, দাবানল,
             নীলাকাশ, নীলাম্বর, ভেদাভেদ, সূত্রানুসারে
অ +আ =আ  : হিমালয় (হিম+আলয়), সিংহাসন, নবাগত, লোকালয়, জলাশয়, বিবেকানন্দ, দণ্ডাদেশ
আ +অ =আ  : যথার্থ (যথা+অর্থ), মহার্ঘ, ভিক্ষান্ন, পূজার্চনা
আ +আ =আ : বিদ্যালয় (বিদ্যা +আলয়), মহাশয়, শিক্ষায়তন, সদানন্দ
২. ঈ (ী)
ই +ই =ঈ   : রবীন্দ্র (বরি +ইন্দ্র), মহীন্দ্র, অতীন্দ্র, অভীষ্ট, অতীষ্ট, প্রতীতি, অধীন, অতীত
ই +ঈ =ঈ   : প্রতীক্ষা (প্রতি +ঈক্ষা), পরীক্ষা, সমীক্ষা, গিরীশ, অধীশ্বর, ক্ষিতীশ, মনীশ
ঈ +ই =ঈ   : রথীন্দ্র (রথী+ইন্দ্র), অবনীন্দ্র, সতীন্দ্র, সুধীন্দ্র, ফণীন্দ্র, মহীন্দ্র, শচীন্দ্র
ঈ +ঈ =ঈ   : শ্রীশ (শ্রী+ঈশ), মহীশ
৩. ঊ (ূ)
উ +উ =ঊ  : কটূক্তি (কটু+উক্তি), সাধূক্তি, ভানূদয়, বিধূদয়, গুরূপদেশ, অনূদিত, মরূদ্যান
উ +ঊ =ঊ  : লঘূর্মি (লঘু+ঊর্মি), সিন্ধূর্মি, অনূর্ধ্ব, তনূর্ধ্ব, বহূর্ধ্ব
ঊ +উ =ঊ  : বধূৎসব (বধূ+উৎসব), ভূত্থিত, বধূক্তি
ঊ +ঊ =ঊ  : ভূর্ধ্ব (ভূ+ঊর্ধ্ব), সরভূর্মি
৪ এ (ে)
অ +ই =এ   : শুভেচ্ছা (শুভ+ইচ্ছা), নরেন্দ্র, দেবেন্দ্র, প্রেমেন্দ্র, গজেন্দ্র, জয়েন্দ্র, স্বেচ্ছা, পূর্ণেন্দু
অ +ঈ =এ   : অপেক্ষা (অপ+ঈক্ষা), গণেশ, নরেশ, সুরেশ, প্রাণেশ, ভবেশ, পরমেশ্বর, সর্বেশ্বর
আ +ই =এ   : যথেচ্ছা (যথা+ইচ্ছা), যথেষ্ট, মহেন্দ্র, রাজেন্দ্র
আ +ঈ =এ  : মহেশ (মহা+ঈশ), রমেশ, ঢাকেশ্বরী, উমেষ
৫ ও (ো)
অ +উ =ও  : সহোদয় (সহ+উদয়), দামোদর, উত্তরোত্তর, নরোত্তম, পরোপকার, বোধোদয়, প্রশ্নোত্তর,
            হিতোপদেশ, সর্বোত্তম
অ +ঊ =ও : নবোঢ়া (নব+ঊঢ়া), চলর্মি, দেহোর্ধ্ব, পর্বতোর্ধ্ব, গৃহোর্ধ্ব
আ +উ =ও  : যথোচিত (যথা+উচিত), মহোৎসব, যথোপযুক্ত, মহোপকার
আ +ঊ =ও  : পদ্মোর্মি (পদ্ম+ঊর্মি), গঙ্গোর্মি, মহোর্মি, মহোর্ধ্ব
৬ ঐ (ৈ)
অ +এ =ঐ  : জনৈক (জন+এক), হিতৈষী
অ +ঐ =ঐ  : মতৈক্য (মত+ঐক্য), রাজৈশ্বর্য
আ +এ =ঐ  : তথৈব (তথ+এব), সদৈব, তথৈবচ, বসুধৈব
আ +ঐ =ঐ  : মহৈশ্বর্য (মহা+ঐশ্বর্য), মহৈরাবত
৭. ঔ (ৌ)
অ +ও =ঔ  : বনৌষধি (বন +ওষধি), জলৌকা
অ +ঔ =ঔ  : পরমৌষধি (পরম+ঔষধি), উত্তমৌষধি,
আ +ও =ঔ  : মহৌষধি (মহা +ওধষি), লতৌষধি, সদৌজস্বী
আ +ঔ =ঔ  : মহৌষধ (মহা +ঔষধ), মহৌদার্য, দিবৌষধ, মহৌৎসক
৮. আর  
অ +ঋ =অর : দেবর্ষি (দেব +ঋষি), সপ্তর্ষি
আ +ঋ =অর : মহর্ষি (মহা +ঋষি), রাজর্ষি
 ব্যতিক্রম    : উত্তম+ঋণ=উত্তমর্ণ, অধম+ঋণ=অধমর্ণ, বন্যা+ঋত=বন্যার্ত, বেদনা+ঋত=বেদনার্ত
৯, য-ফলা, ই/ঈ+অ/উ/ঊ/এ
: অতি+অন্ত =অত্যন্ত, অতি+আচার=অত্যাচার, অতি+উন্নতি=অত্যুন্নতি, প্রতি+ঊষ=প্রত্যূষ, প্রতি+এক=প্রত্যেক, নদী+অম্বু=নদ্যম্বু, যদ্যপি, প্রত্যক্ষ, গত্যন্তর, ব্যর্থ, ইত্যবসর, প্রত্যাগমন, অভ্যাগত, ইত্যাকার, ইত্যাদি, প্রত্যাদেশ, অত্যাশ্চর্য
১০. ন্ব, /শ্ব/স্ব     অনু/মনু+অ/ই/এ=ন্ব, শু+অ/অ=শ্ব, সু+অ/আ=স্বা
: অনু+ইত=অন্বিত, মনু+অন্তর=মন্বন্তর, পশু+আচার=পশ্বাচার, সু+অচ্ছ=স্বচ্ছ, সু+আগতম=স্বাগতম, অন্বেষণ, পশ্বধম, স্বল্প, স্বস্তি , স্বাগত
১১. অয়, আয়, আয়ি, এ+অ=অয়, এ+আ=অয়া, ঐ+অ=আয়, ঐ+ই=আয়ি
: শে+অন=শয়ন, শে+আন= শয়ান, গৈ+অক= গায়ক, নৈ+ইকা=নায়িকা, নয়ন, বয়ন, নায়ক, গায়িকা
১২. অব, আব, আই, ও+অ=অব, ও+আ=অবা, ও+ই=ই, ও+এ=এ ঔ+অ=আব, ঔ+ই=আবি, ঔ+ই=আবু
: ভো +অন=ভবন, গো +আদি=গবাদি, পো +ইত্র=পবিত্র, গো +এষণা=গবেষণা, পৌ +অক=পাবক, নৌ +ইক=নাবিক, ভৌ +উক=ভাবুক, পবন
১৩. অ/আ/আই, ঋ+অ=অ, ঋ+আ=আ, ঋ+ই=আই
: পিতৃ+অনুমতি=পিত্রানুমতি, পিতৃ+আলয়=পিত্রালয়, ভ্রাতৃ+ইচ্ছা=ভ্রাত্রিচ্ছা, পিত্রাদেশ

ব্যঞ্জনসন্ধির ব্যবহার বা বিচ্ছেদ
১. গ, ক +অ=গ, ক +আ=গা, ক+উ=গু, ক+ঈ=গী, ক+ঐ=গৈ
: দিক+অন্ত =দিগন্ত, বাক+আড়ম্বর=বাগাড়ম্বর, প্রাক+উক্ত=প্রাগুক্ত, বাক+ঈশ=বাগীশ, প্রাক+ ঐতিহাসিক = প্রাগৈতিহাসিক, বাগর্থ, পৃথগন্ন, বাগীশ্বরী
২. চ্চ. ৎ+চ=চ্চ, দ+চ=চ্চ
: উৎ+চারণ=উচ্চারণ, বিপদ+চয়=বিপচ্চয়, শরচ্চন্দ্র, সচ্চিন্তা, চলচ্চিত্র
৩. চ্ছ, অ+ছ=চ্ছ, আ+ছ=আচ্ছ, ই+ছ=ইচ্ছ, উ+ছ=উচ্ছ, ৎ+ছ=চ্ছ, দ+ছ=চ্ছ, ৎ+শ=চ্ছ, ৎ+স=চ্ছ, দ+শ=চ্ছ  
: স্ব+ছন্দ=স্বচ্ছন্দ, আ+ছন্ন=আচ্ছন্ন, পরি+ছেদ=পরিচ্ছেদ, অনু+ছেদ=অনুচ্ছেদ, তৎ+ছবি=তচ্ছবি, বিপদ+ ছায়া=বিপচ্ছায়া, উৎ+শৃঙ্খলা=উচ্ছৃঙ্খলা, কুৎ+সিত=কুচ্ছিত, তদ+শক্তি=তচ্ছক্তি, প্রচ্ছদ, একচ্ছদ, মুখচ্ছবি, বৃক্ষচ্ছায়া, অঙ্গচ্ছেদ, অবচ্ছেদ, কথাচ্ছলে, খেলচ্ছলে, পরীক্ষাচ্ছলে, ব্যবচ্ছেদ, আলোকচ্ছটা, আচ্ছাদন প্রতিচ্ছবি, বিচ্ছেদ, বিচ্ছিন্ন তরুচ্ছায়া, উচ্ছেদ, সচ্ছাত্র, তচ্ছায়া, উচ্ছিন্ন, তচ্ছিদ্র, উচ্ছ্বাস, চলচ্ছক্তি, উচ্ছন্ন, উচ্ছব, বচ্ছর
৪. জ /জ্জ /জ্ঝ     চ+অ=জ, ৎ+জ=জ্জ, চ+জ=জ্জ, ত/দ+জ=জ্জ, ৎ+ঝ=জ্ঝ, দ+জ=জ্জ, দ+জ=জ্ঝ
: অচ+অন্ত =অজন্তা, যাবৎ+জীবন=যাবজ্জীবন, পাঁচ+জন=পাঁজ্জন, নাত+জামাই= নাজ্জামাই, কুৎ+ঝটিকা = কুজ্ঝটিকা, বিপদ+জনক=বিপজ্জনক, এতদ+ঝঙ্কার=এতজ্ঝঙ্কার, ণিজন্ত, তজ্জন্য, উজ্জ্বল, জগজ্জীবন, তজ্জাতীয়, বজ্জাত, ঘজ্জামাই
৫. ড়, ট+অ=ড়, ট+আ =ড়া : ষট+ঋতু=ষড়ঋতু , ষট+আনন=ষড়ানন  
৫. দ, ৎ+অ=দ, ৎ+ই=দি, ৎ+ঈ=দী, ৎ+উ=দু, ৎ+ঔ=দৌ
: কৃৎ+অন্ত =কৃদন্ত, সৎ+ইচ্ছা=সদিচ্ছা, জগৎ+ঈশ্বর=জগদীশ্বর, সৎ+উদ্দেশ্য=সদুদ্দেশ্য, মহৎ+ঔষধ=মহদৌষধ, তদবধি, সদাশয়, সদানন্দ, মৃদঙ্গ, বৃহদারণ্যক, জগদিন্দ্র, জগদীশ, সদুপদেশ
৬. ব, প+অ=ব    : সুপ+অন্ত =সুবন্ত
৭. দ্বিত্ব ব্যঞ্জন—ৎ+ড=ড্ড, ৎ+ঢ=ড্ঢ, ৎ+হ=দ্ধ, ৎ+ল=ল্ল, ৎ+ট=ট্ট, ৎ+ঠ=ট্ঠ   
: উৎ+ডিন=উড্ডিন, বৃহৎ+ঢক্কা=বৃহড্ঢক্কা, উৎ+হার=উদ্ধার (হত/হতি), উৎ+লেখ=উল্লেখ, বৃহৎ+টীকা =বৃহট্টীকা, বৃহৎ+ঠাকুর=বৃহট্ঠাকুর , উদ্ধত, উদ্ধৃত, পদ্ধতি, তদ্ধিত, উল্লম্ফ, উল্লঙ্ঘন, বিদ্যুল্লতা, উল্লাস, বৃহট্টক্কা
৮. দ্বিত্ব ব্যঞ্জন—চ+শ=শশ, র+বর্ণ=দ্বিত্ব
: পাঁচ+শ=পাঁশ্শ, চার+দিন=চাদ্দিন, সাশ্শ, তদ্দিন, হত্তাল
৯. দ্বিত্ব ব্যঞ্জন—দ+ল=ল্ল, দ+ট=ট্ট, দ+ক/স =ৎ, ধ+প=ৎ
: উদ+লিখিত=উল্লিখিত, তদ+টীকা=তট্টীকা, তদ+সম=সংস্কৃত, ক্ষুধ+পিপাসা=ক্ষুৎপিপাসা, হৃৎকম্প, তৎকাল, বিপৎসঙ্কুল, হৃৎকমল
১০. ং, ম+ক=ঙ্ক/ংগ, ম+ক্ষ=ংক্ষ, ম+খ্যা=ংখ, ম+গ=ংগ, ম+ঘ=ংঘ, ম+শ=ংশ, ম+স=ংস, ম+য=ং, ম+হ=ংহ, ম+র=ংর, ম+ল=ংল, ম+ব=ংব  
: সম+কর=সঙ্কর, সম+ক্ষোভ=সংক্ষোভ, সম+খ্যা==সংখ্যা, সম+গীত=সংগীত, সম+ঘ=সংঘ, সম+শয়=সংশয়, সম+ সার=সংসার, সম+যোজন=সংযোজন, সম+হার=সংহার, সম+রক্ষণ=সংরক্ষণ, সম+লাপ=সংলাপ, সম+ বর্ধনা= সংবর্ধনা, সংকল্প, সংকলন, সংকীর্ণ, শংকা, সংক্রম, অহংকার, সঙ্গম, বিহঙ্গম, সংগত, সংগঠন , সংঘাত, সংসপ্তক, সংযোগ, স্বয়ংবরা, সংবাদ, কিংবা, বারংবার, সংবরণ
১১. দ্বিত্ব ব্যঞ্জন—ম+চ=ঞ্চ, ম+জ=ঞ্জ, ম+ত=ন্ত, ম+দ=ন্দ, ম+ন=ন্ন, ম+প=ম্প, ম+ভ=ম্ভ, ম+ম=ম্ম
: সম+চয়=সঞ্চয়, সম+জীবন=সঞ্জীবন, সম+তাকা=সন্তাকা, সম+দর্শন=সন্দর্শন, সম+ন্যাস=সন্ন্যাস, সম+ পূর্ণ=সম্পূর্ণ, সম+ভার=সম্ভার, সম+মান=সম্মান, কিন্নর
১২. প্রত্যয়—না, নী, ত/ক্ত, ঞ, থ, আমি, আলি, এক, উক, ইয়াল (য়াল), ইয়া, এ/য়ে/য় /য়া /আ, আ/ই-কার লোপ
: যাচ+না=যাঞ্চা, রাজ+নী=রাজ্ঞী, নষ+ত= নষ্ট, দৃশ+ত=দৃষ্ট, যজ+ঞ=যজ্ঞ, ষষ+থ=ষষ্ঠ, বোকা+ আমি = বোকামি, রুপ+আলি=রুপালি, বার+এক=বারেক, নিন্দা+উক=নিন্দুক, গাড়ি+আল=গাড়িয়াল, নাও+ ইয়া= নাইয়া, মা+এ=মায়ে, কাঁচা+কলা=কাঁচকলা, বৃষ্টি, হৃষ্ট, কৃষ্টি, বুদ্ধ, মুগ্ধ, পাগলামি, ছেলেমি, মেয়েলি, গোঁড়ামি, ঢিলেমি, শাঁখারি, মিতালি, সোনালি , শতেক, খানেক, কতেক, অর্ধেক, তিলেক, তিনেক, ধনিক, বণিক, কুড়িক, গুটিক, হিংসুক, মিথ্যুক, লাঠিয়াল, ঘড়িয়াল (ই লোপ পায়), গাঁইয়া (ও লোপ পায়)
ভায়ে, ঝিয়ে, ছায়ায়, আলয়, বাবুআনা, ঘোড়দৌড়, নাতবউ

বিসর্গসন্ধির ব্যবহার বা বিচ্ছেদ
১. শ, ষ, স, ঃ +চ=শ্চ   : নিঃ +চয় =নিশ্চয়, দুঃ +চিন্তা =দুশ্চিন্তা, নিশ্চিহ্ন, নিশ্চিন্ত, দুশ্চিন্তা, দুশ্চরিত্র
ঃ +ট/ঠ=ষ : নিঃ +ঠুর =নিষ্ঠুর, ধনুষ্টংকার, নিষ্ঠা, নিষ্ঠুর, নিষ্ফল, নিষ্কাম, আবিষ্কৃত, চতুষ্কোণ, ভ্রাতুষ্পুত্র, দুষ্প্রাপ্য, চতুষ্পদ, নমষ্কার, বহিষ্কার, পরিষ্কার, পুরষ্কার, তিরষ্কার, দুষ্কার্য
ঃ +ত/থ=স : নিঃ +তার =নিস্তার, নিস্তেজ, অধস্তন, প্রস্থান, দুস্তর, মনস্কাম, ভাস্কর, তেজস্কর
২. চ্ছ, ঃ +ছ=চ্ছ : নিঃ+ছিদ্র=নিচ্ছিদ্র
৩. ও, ঃ +ও=ও : মনঃ +যোগ=মনোযোগ
ব্যতিক্রম—মনোহোর, অধোগতি, সদ্যোজাত, ততোধিক, বয়োধিক, বয়োবৃদ্ধ, পুরোভাগ, মনোহর, তপোবন, মনোজগৎ, অধোগতি, মনোরম, মনোরথ, অকুতোভয়, নভোযান, যশোলাভ, মনোরঞ্জন, সরোবর, মনোনয়ন
— মনঃকষ্ট, অধঃপতন, অন্তঃকরণ, অতঃপর, বহিঃপ্রকাশ
৪. র—ঃ +অ=র : দুঃ +গতি =দুর্গতি, আশীর্বাদ, আবির্ভাব
৫. ঃ +জ/য/র/ল/ব/হ= র /রেফ
: দুরাচার, নিরবধি, দুরবস্থা, নিরাপদ, নির্জীব, দুর্যোগ, দুর্বোধ্য, আশীর্বাদ, আবির্ভাব, নির্ভয়, প্রাদুর্ভাব, বহির্গমন, অহর্নিশ, পুনর্বার, পুনর্মিলন, অন্তর্গত, প্রাতভ্রমণ, অন্তরাত্মা
৬. ঃ +র =র : নিঃ+রস =নিরস/নীরস, নিরব/নীরব, নিরোগ/নীরোগ