Showing posts with label বাংলা বানান নিয়ম. Show all posts
Showing posts with label বাংলা বানান নিয়ম. Show all posts

Wednesday, 18 May 2016

বাংলা বানানের নিয়ম

সংস্কৃত বর্ণন থেকে বানান এসেছে যার অর্থ শব্দের মধ্যকার বর্ণসমূহের বিশ্লেষণ বা ক্রমিক বর্ণন (বর্ণ+ অন)। শব্দের উৎপত্তি, অর্থ ও গঠন অনুসারে শব্দের প্রমিত লিখিতরূপকে বানান বলে। Spellingisthe act of namingthe letters of words অর্থাৎ বানান হলো শব্দে অবস্থানরত বর্ণের লিখিত নিয়ম। শব্দ বিভিন্ন ভাষা থেকে আসে বলে বানান মনে রাখা কষ্টসাধ্য। বানান একটি পদ্ধতি তাই সতর্কতার সঙ্গে পাঠ করে মনে রাখতে হয়। বানানের নির্দিষ্টরূপ দেয়া যায় না বলে বানানকে ‘শুদ্ধ বানান’ না ডেকে ‘প্রমিত বানান’ ডাকা হয়। শব্দের মূল উচ্চারণ, ধ্বনিব্যবস্থার গঠনরীতি অনুসারে লিখিত বানানকে প্রমিত বানান বলে। প্রথম প্রমিত বানান ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে। আর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে এবং বাংলা একাডেমি ১৯৯৪ সালে।
বানান প্রকরণ
বর্তমানে বাংলা ভাষার প্রচুর শব্দভাণ্ডার তা একদিনে নয়, অনেক কাল-অনেক শতাব্দী ধরে জড়ো হয়েছে। এসব শব্দ এসেছে-অস্ট্রিকভাষা, দ্রাবিড়ভাষা, আর্য বা বৈদিকভাষা, সংস্কৃতভাষা, পালিভাষা, প্রাকৃতভাষা, অপভ্রংশভাষা, দেশিভাষা, আঞ্চলিকভাষা, প্রাদেশিকভাষা, বিদেশিভাষা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। বৈদিক ভাষার সংস্কার করার পর হয় সংস্কৃতভাষা। সংস্কৃতভাষা সংস্কার হলে সেটি হয় সাধুভাষা। সাধুভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রেখে আমরা পেয়েছি চলিতভাষা। এই যে ধারাবাহিক পরিবর্তন তা বহু বছরের, বহু কালের। শব্দের বানান দুইভাবে নির্ধারণ করা যায়। যেমন :
ক) শব্দের উৎপত্তিগত বানান : শব্দের উৎপত্তি অনুসারে শব্দের বানান নির্ধারণ করা যায়। যেমন:
১. সংস্কৃত শব্দ: সংস্কৃত শব্দ হুবহু সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে বলে এর বানানের কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন: গাত্র, কৃষ্ণ, গৃহিণী, মস্তক, হস্ত, কর্ণ, বৃক্ষ, মৎস্য, স্বর্ণ ইত্যাদি।
২. খণ্ডসংস্কৃত শব্দ: সংস্কৃতজাত শব্দ কিছুটা পরিবর্তন হয়ে খণ্ডসংস্কৃত শব্দ হয়েছে বলে এর বানানের পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: গতর, কেষ্ট, গিন্নি, মাথা, হাত, কান, গাছ, মাছ, সোনা ইত্যাদি।
৩. তদ্ভবশব্দ: সংস্কৃতজাত শব্দ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে তদ্ভব শব্দ হয়েছে বলে এর বানান পরিবর্তন হয়ে যায়। তদ্ভব শব্দের বানান একেবারে খাঁটি দেশি শব্দের মতো। যেমন: হস্ত>হত্থ>হাত, চন্দ্র>চন্দ>চাঁদ, ঈ-কার হয়ে যায় ই-কার। ঊ-কার হয়ে যায় উ-কার। ণ-হয়ে যায় ন। য-ফলা থাকে না। যেমন: বৈশাখী>বোশেখি, কুম্ভীর>কুমির, সূর্য>সুয্যি /সুজ্জি, স্বর্ণ>সোনা, বর্ণ>বরন, কৃষাণ>কিষান, সন্ধ্যা>সন্ধে।
৪. আঞ্চলিক শব্দ: আঞ্চলিক শব্দ অঞ্চলজাত শব্দ বলে এর বানান পুরোটাই পরিবর্তন হয়। যেমন: হাত>ড্যানা, ষাঁড়>হাড় ইত্যাদি।
৫. দেশি শব্দ: বাংলা আদি শব্দ তাই এর বানান তার নিজের মতো। যেমন: কুলা, চুলা, কুড়ি, পেট।
৬. প্রাদেশিক শব্দ: সংস্কৃত বাদে ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষা থেকে এসেছে বলে এর বানান পুরোটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: হিন্দি: কাহানি>কাহিনি, ঠান্ডি>ঠান্ডা। গুজরাটি: হটতাল>হরতাল। তামিল: গুরুট>চুরুট।
৭. বিদেশি শব্দ: বিদেশি শব্দের বানান পুরোটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। সব সময় সব বানানে ই/উ-কার বসে। ঙ/ছ/ঞ্জ/ঞ্চ/ণ/ণ্ট/ণ্ড/ষ্ট না বসে ং/স/শ/ নজ/নচ/ন/ন্ট/ ন্ড/স্ট বসে। যেমন: ফেরেস্তা, স্কুল/কলেজ, আঁশ, জানালা, সাবান, টেক্কা, কাঁচি, লাশ, চা, চিনি, রিকশা, লুংগি, ডেংগু, ঝান্ডা, লন্ঠন, মিসরি (মিছরি), পসন্দ (পছন্দ), তির (ধনুক), ইনজিনিয়ার, সেনচুরি, ব্যাংক, ইনজিন, সেনচুরি, এন্ড, খ্রিস্টার্ন, স্টল, স্টেশন, স্টোর।
৮. পারিভাষিক শব্দ: পারিভাষিক শব্দ শব্দের কার্য, গুণ, স্বাদ ইত্যাদি অনুসারে বিদেশি শব্দ থেকে আগত বলে এর বানান সংস্কৃত বা তদ্ভব অনুসারে হয়ে থাকে। যেমন: পাঠ্যসূচি/ Syllabus, আইন/Act।
খ) শব্দের গঠনগত বানান : শব্দের গঠন অনুসারে শব্দের বানান নির্ধারণ করা যায়। যেমন:
১. সন্ধিযোগে: বর্ণ সংযোগে বা লোপে শব্দ গঠিত হয়। যেমন: বিদ্যালয় (বিদ্যা+আলয়), রবীন্দ্র (রবি+ ইন্দ্র), কটূক্তি (কটু+উক্তি)।
২. সমাসযোগে: দুই বা অধিক শব্দযোগে শব্দ গঠিত হলে এদের বানান তেমন পরিবর্তন না হলেও শুধু মাঝের ঈ-কার ই-কারে পরিণত হয়। যেমন: প্রাণিজগৎ, প্রাণিবিদ্যা, শ্রেণিকক্ষ, নারিচিহ্ন, মন্ত্রিসভা। আবার হাইফেন দিয়ে বা না দিয়েও লেখা যায়। যেমন: ছেলে-মেয়ে/ছেলেমেয়ে, কুসুমের মতো কোমল/কুসুমকোমল, মনরূপ মাঝি/মনমাঝি, শহিদদের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত মিনার/শহিদমিনার।
৩. উপসর্গযোগে: যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নাই তবে অন্য শব্দের আগে বসে নতুন শব্দ গঠন করতে পারে। এদের বানান অপরিবর্তিত থাকে। যেমন: আগাছা (আ-গাছা), নিখুঁত, নীরব, প্রধান, পরাজয় ইত্যাদি।
৪. প্রত্যয়যোগে: যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নাই তবে অন্য শব্দের পরে বসে নতুন শব্দ গঠন করতে পারে। এদের বানান অপরিবর্তিত থাকে। যেমন: বোকামি (বোকা+আমি), ডুবুরি (ডুব+উরি), মাধুর্য (মধুর+য), দৈন্য (দীন+য)।
৫. বিভক্তিযোগে: যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নাই তবে অন্য শব্দের (ধাতু ও নামশব্দ) পরে বসে নতুন শব্দ গঠন করতে পারে। যেমন: হাতা (হাত+অ), করব (কর+ব), গাইছি (গাই+ছি), রহিমরা (রহিম+রা)।
বানানের সমস্যা
বিভিন্নভাবে বানান প্রমিত হয় না। যেমন :
১. শব্দের উৎপত্তি ও গঠন সম্পর্কে না জানা
২. কার, ফলা, রেফ না জানা
৩. যে যার মতো যুক্তি দিয়ে শব্দের বানান লেখা
বাংলা প্রমিত বানানের নিয়ম
১. সকল প্রাদেশিক ও বিদেশি শব্দে ঈ-কার না বসে ই-কার বসে। যেমন: শুমারি, আমদানি, খানদানি, খুশকি, খুশি, বন্দি, জংগি, জমি, জরি, জামদানি, জিনজির, জিন্দাবাদ, জিন্দেগি, দরজি, দাগি, বিরিয়ানি, মুরগি, আবির, আমিন, আসামি, গরিব, কেরানি, দাদি, নানি, চাচি, ফুপি, মাসি, ভাবি, কাহিনি, কোম্পানি, জানুয়ারি, সেনচুরি, চৌধুরি, লুংগি।
২. বিদেশি শব্দে ঙ/ছ/ ঞ্জ/ঞ্চ/ণ/ণ্ট/ণ্ড /ষ্ট না বসে ং/স/শ/ই/ নজ/ নচ/ন/ ন্ট/ন্ড/স্ট বসে। যেমন: লুংগি, ডেংগু, ব্যাংক, স্যাম, ইনজিন, সেনচুরি, স্টার্ন, এন্ড, ঝাণ্ড/ ঝান্ডা, লন্ঠন, স্কুল, খ্রিস্টার্ন, স্টল, স্টেশন, স্টোর।
৩. ক্রিয়া, সংখ্যাবাচক, বিদেশি, প্রাদেশিক ও তদ্ভব শব্দে সব সময় ই-কার বসে। যেমন: আসুন, বসুন, করুন, শুনুন, হাসুন, বসুন, বাসুন, কাঁদুন, ভাবুন, দুই, কুড়ি, একুশ, চুয়ান্ন, চুয়াত্তর, চুরাশি, চুরানব্বই, নুন, রজু, রুহু, মুলো, তুলো, সুয্যি, ধুলো।
৪. কি: যার উত্তর হ্যাঁ/না-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ অর্থাৎ সম্মতিজ্ঞাপন প্রশ্নে ‘কি’ বসে। হ্যাঁ/না বোঝাতে ‘কি’ বসে। যেমন: তুমি কি খাবে? এই কি’র উচ্চারণ সংক্ষিপ্ত হবে। যেমন : হ্যাঁ/না। কি সর্বনাশ, কি জ্বালা।
কী: যার উত্তর বিষয়ের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ বিষয়জ্ঞাপন প্রশ্নে ‘কী’ বসে। ইংরেজি Wh (Who, What, Which, When, Where, How) দিয়ে প্রশ্ন করা হলে ‘কী’ বসে।। নির্দিষ্ট করে জানার জন্য কী, কোন, কোন উপায়ে, কবে, কেমন, কত, কোথায়, কখন, কিভাবে, কিসের জানতে চাইলেও কী ব্যবহৃত হয়। আবেগ/সন্দেহ /বিস্ময় /লজ্জা/ঘৃণা/সন্দেহ বোঝাতে ‘কী’ বসে। কী টেনে উচ্চারণ করতে হয়। যেমন: তুমি কী খাবে?—ভাত। What is your name? /Who are you? /Where will you go?/তুমি কী খাও?/এই কী’র উচ্চারণ দীর্ঘ হবে—ভাত। কী পড়—বই না পেপার। কী আশ্চর্য! কী সুন্দর! রবীন্দ্রনাথের জন্ম কী ১৮৬২ সালে?
৫. ক্রিয়াবাচক শব্দে সব সময় ই-কার বসে। যেমন: করি, মারি, ধরি, ভরি, চরি, পড়ি, পরি, চলি, বলি, ধরি, ভাবি।
৬. জাতির ভাষা শব্দে ই-কার বসে। যেমন: দেশি, বিদেশি, বাঙালি, বাংলাদেশি, জাপানি, ইরাকি, আরবি, ফারসি, ইংলিশ, হিন্দি।
৭. সন্ধিজাত শব্দে ঈ-কার বসে। যেমন:
ই+ই=ঈ      : রবীন্দ্র (বরি+ইন্দ্র), অভীষ্ট, অতীষ্ট, অধীন, অতীব, অতীত।
ই+ঈ= ঈ     : প্রতীক্ষা (প্রতি+ঈক্ষা), পরীক্ষা, সমীক্ষা, ক্ষিতীশ, মনীশ।
ঈ+ই=ঈ      : রথীন্দ্র (রথী+ইন্দ্র), সতীন্দ্র, সুধীন্দ্র, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র, মহীন্দ্র।
ঈ+ঈ=ঈ      : শ্রীশ (শ্রী+ঈশ), দিল্লীশ্বর, অবীনশ্বর, মহীশ।
৮. সন্ধিজাত শব্দে ঊ-কার বসে। যেমন:
উ+উ=ঊ     : কটূক্তি (কটু+উক্তি), সাধূক্তি, গুরূপদেশ, অনূদিত, মরূদ্যান, বধূদয়।
উ+ঊ=ঊ     : লঘূর্মি (লঘু +ঊর্মি), সিন্ধূর্মি, অনূর্র্ধ্ব, তনূর্র্ধ্ব, বহূর্র্ধ্ব।
ঊ+উ=ঊ     : বধূৎসব (বধূ+উৎসব), ভূত্থিত, বধূক্তি কিন্তু মধু+উৎসব ‘মধূৎসব' হবে না।
ঊ+ঊ= ঊ    : ভূর্ধ্ব, (ভূ+ঊধ্ব), সরভূর্মি।
৯. উপসর্গজাত শব্দে ই/ঈ-কার বসে। যেমন:
নিঃ+র হলে ঈ-কার হয় : নীরস (নিঃ+রস), নীরক্ত, নীরব, নীরোগ।
নিঃ+অন্যবর্ণ ই-কার হয়     : নির্গমন (নিঃ+গমন), নির্ধন, নির্জীব, নির্ভয়।
নিঃ+অ/আ থেকে ‘র’ হলে ই-কার হয়: নি অপরাধ (নিঃ+ অপরাধ), নিরবধি, নিরাকুল, নিরাভরণ, নিরাশ্রয়, নিরাপদ।
১০. একক শব্দর সমাসবদ্ধ শব্দে ঈ/ই-কার বসে। যেমন:
ঈ>ইত্ব : একাকী>একাকিত্ব, কৃতী>কৃতিত্ব, দায়ী>দায়িত্ব, মন্ত্রী>মন্ত্রিত্ব, স্থায়ী>স্থায়িত্ব।
ঈ>ইতা : উপকারী>উপকারিতা, উপযোগী>উপযোগিতা, প্রতিযোগী> প্রতিযোগিতা।
ঈ>ইনী : অপকারী> অপকারিনী, অভিমানী> অভিমানিনী, সঙ্গী>সঙ্গিনী।
ঈ>ই  : প্রাণী>প্রাণিবিদ্যা, মন্ত্রী>মন্ত্রিসভা, নারী>নারিবাচক, নদী>নদিমাতৃক।
১১. ৎ (উৎ) যুক্ত শব্দে ব-ফলা বসে না। যেমন: উচ্ছল, উচ্ছেদ, উচ্ছিন্ন, উজ্জীবন, কজ্জল, জগজ্জন, তজ্জন্য, বিপজ্জনক, সজ্জন।
১২. ৎ (উৎ) যুক্ত শব্দে ব-ফলা বসে। যেমন: উজ্জ্বল, উচ্ছ্বাস, উচ্ছ্বসিত, উদ্বর্ত, উদ্বর্তন, উদ্বাস্তু, উদ্বিগ্ন, উদ্বুদ্ধ, উদ্বুত্ত, উদ্বেগ, উদ্বেল, উদ্বোধক, উদ্বোধন, জগদ্বন্ধু, তদ্ব্যতীত, বিদ্যুদ্বগে, সদ্ব্যবহার।
১৩. অহম/ভয়ং/শুভম/সম/ম থাকলে ‘ঙ’ না বসে ‘ং’ বসে। যেমন: অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, সংসার, অলংকার, সংকেত, সংক্ষেপ, সংকট, সংহার, সংরক্ষণ, সংলাপ, সংকল্প, সংকলন, সংকীর্ণ, শংকা, অহংকার, সংগঠন, সংঘাত, সংযোগ, সংবাদ, আড়ং, এবং, সং, ঠ্যাং, বরং, রং, সুতরাং, ঢং, শিং, স্বয়ং। ‘অ’ ধ্বনির পর ক খ গ ঘ ক্ষ থাকলে ‘ঙ্ক’ বসে। যেমন: অঙ্ক, অঙ্গ, অঙ্কন, আতঙ্ক, আকাঙ্ক্ষ, কঙ্কাল, অঙ্কুর, চিত্রাঙ্কন, জলাতঙ্ক, পালঙ্ক, পঙ্কজ, বঙ্গ, বিহঙ্গ, সঙ্গ, শঙ্কা, শঙ্খ, শৃঙ্খল, হিমাঙ্ক।
১৪. বিসর্গ বর্জিত শব্দ। যেমন: অন্তরঙ্গ, অন্তরীণ, অন্তরাল, নিসর্গ, নিষেধ, নিসৃত, প্রাতরাশ, বক্ষ্যমাণ, বয়োবৃদ্ধ, মনস্তত্ত্ব, মনোদুঃখ, মনোবিজ্ঞান, অন্তত, অংশত, অধ, অহ, অহরহ, আয়ু, ইতস্তত, ক্রমশ, তপ, প্রথমত, নভ, পয়, প্রায়শ, বস্তুত, মন,  অন্তস্থ, নিস্পন্দ, নিস্কব্ধ, নিস্পৃহা, নিশ্বাস, দুস্থ, মনস্থ, বক্ষস্থল।
১৫. বিসর্গ আশ্রিত শব্দ। যেমন: অন্তঃকরণ, অন্তঃপুর, অন্তঃসার, নিঃশেষ, নিঃসৃত, প্রাতঃকাল, বক্ষস্থল, বয়ঃক্রম, বয়ঃসন্ধি, মনঃক্ষুণ্ণ, মনঃসংযোগ, স্বতঃসিদ্ধ, অতঃপর, অধঃপতন, অন্তঃশীল, অন্তঃসার, চক্ষুঃশূল, দুঃশাসন, দুঃসংবাদ, দুঃসময়, দুঃসহ, দুঃসাধ্য, দুঃসাহসিক, দুঃস্থ, দুঃস্বপ্ন, নিঃশক্তি, নিঃশত্রু, নিঃশব্দ, নিঃশর্ত, নিঃশেষ, নিঃশ্বসন, নিঃশ্বাস, নিঃসংকোচ, নিঃসংশয়, নিঃসঙ্গ, নিঃসত্ত্ব, নিঃসন্তান, নিঃসন্দেহ, নিঃসম্বল, নিঃসরণ, নিঃসহায়, নিঃসাড়, নিঃসারণ, নিঃসৃত, নিঃস্নেহ, নিঃস্পৃহ, নিঃস্ব, নিঃস্বত, নিঃস্বার্থ, পয়ঃপ্রণালী, পুনঃপুন, পুনঃপ্রবেশ, পৌনঃপুনিক, প্রাতঃক্রিয়া, বয়ঃকনিষ্ঠ, বয়ঃপ্রাপ্ত, বহিঃপ্রকাশ, মনঃকষ্ট, মনঃপূত, মনঃস্থ, সদ্যঃপ্রসূত, স্বঃপ্রমাণিত, স্বঃতস্ফূর্ত।
১৬. নাসিক্যজাত শব্দে চন্দ্রবিন্দু বসে। যেসব সংস্কৃত শব্দে ন/ণ/চ/ম/ং বর্ণ থাকে সেসব বর্ণ উঠে চন্দ্রবিন্দু বসে। যেমন: অঙ্কন>আঁকা, অংশু>আঁশ, বংশি>বাঁশ, কঙ্ক>কাঁক/কাঁখ, কঙ্কণ>কাঁকন, বংশ>বাঁশ, হংস>হাঁস, অন্ধকার>আঁধার, স্কন্ধ>কাঁধ, বন্ধন>বাঁধা, খুন্টি>খুঁটি, কণ্টক>কাঁটা, কণ্টকি>কাঁঠাল, চন্দ্র>চাঁদ, কাঞ্চা>কাঁচা, ক্ষত>খুঁত/খুঁৎ, ক্ষোড>খুঁটি, সূচ>সুঁই, উচ্চ>উঁচু, উচ্ছিষ্ট>এঁটো, পঞ্চ>পাঁচ, ক্রন্দন>কাঁদা, ইন্দুর>ইঁদুর, সিন্দুর>সিঁদুর, স্কন্ধ>কাঁধ, বন্ধন>বাঁধন, সন্ধ্যা>সাঁঝ, কন্থা>কাঁথা, দন্ত্য>দাঁত, কম্পন>কাঁপা, পিপিলিকা>পিঁপড়া।
দেশিশব্দে চন্দ্রবিন্দু : ঝাঁটা, ডাঁস, ঢেঁকি, যাঁতা।
বিদেশিশব্দে চন্দ্রবিন্দু :
আরবি : তাঁবু, তুঁত, হুঁকা।
ফারসি : জাঁহাপনা, পিঁয়াজ, ফাঁদ, ফাঁশ, বাঁদি, হুঁশ, হুঁশিয়ার।
তুর্কি  : কাঁচি, বোঁচকা।
ফরাসি : আঁতাত, দাঁতাত, রেনেসাঁ।
পর্তুগিজ : পেঁপে।
হিন্দি  : কাঁচা, খাঁচা, গাঁজা, ঝাঁক, ঝুঁকি, টুঁটি, বাঁদি, ভোঁতা।
ইংরেজি : কৌঁসুলি, জাঁদরেল, রেস্তরাঁ।
১৭. ণ/ন-এর বানান /ণত্ববিধান
বাংলা তৎসম শব্দের ‘ণ’ বর্ণের সঠিক ব্যবহার বিধিকে ণত্ববিধান বলে। অথবা বাংলা শব্দে ‘ণ’ ও ‘ন’ বর্ণের সঠিক ব্যবহার বিধিকে ণত্ববিধান বলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতে, ‘শুধু সংস্কৃত শব্দে যেখানে ণ আছে, বাংলা ভাষায় ব্যবহারের সময় সেখানে তাই রাখতে হবে। এটাই ণত্ববিধান।’ কথা তৈরি করতে বর্ণ, শব্দ ও বাক্য লাগে কিন্তু অনেক সময় শব্দ ও বাক্যকে উপেক্ষা করে বর্ণ কথা বলে। যেমন:
নতুন অর্থে    : কিরে ন বউকে নিয়ে কেমন আছিস?
সংখ্যা অর্থে   : ন জন মানুষ এক পরিবারে।
নিষেধ/অভাব/নাসূচক : সে ন মানুষ ন জানোয়ার।
ণ বর্ণের বানান
১. সংস্কৃত শব্দে স্বভাবতই ‘ণ’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : গ্রহণ, স্বর্ণ, পণ্য, বীণা।
২. ঋ, ঋ-কারের পর ‘ণ’ বসে। যেমন : ঋণ, তৃণ।
৩. র, র-ফলা, রেফ-এর পর ‘ণ’ বসে। যেমন : চরণ, প্রাণ, কর্ণ।
৪. সাধারণত ষ-এর পর ‘ণ’ বসে। যেমন : ভাষণ।
৫. ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড) যুক্ত শব্দে ‘ণ’ বসে। যেমন : কণ্টক, কণ্ঠ, দণ্ড।
৬. নার, পার, পর-এর পর অয়ন যুক্ত শব্দে ‘ণ’ বসে। যেমন : নারায়ণ, রামায়ণ, পরায়ণ।
৭. প্র, পরি, নির উপসর্গ গঠিত শব্দে ‘ণ’ বসে। যেমন : প্রণাম, পরিত্রাণ, নির্ণয়, পরিণতি।
৮. অপর, প্র, পর, পূর্ব এ ওপর হ-এর সঙ্গে ‘ণ’ যুক্ত হয়। যেমন : অপরাহ্ণ, পরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ।
ন বর্ণের বানান
১৮. নাবাচক ক্রিয়া বিশেষণ ও উপসর্গ: নাই, নয়, না, নে, নি ন>নঞ> নাইং> নাই>নাই>না>নি>নে। ক্রিয়াবিশেষণ বা না বাচক শব্দ -নাই, নাই, নহে, নয়, না, আলাদা বসে। আর নে, নি ক্রিয়ার সঙ্গে বসে। দেখি নাই, দেখি না, দেখিনে, দেখিনি। এরা সাধারণ বর্তমান বা সাধারণ হিসাবেও বসে। নি দিয়ে অতীতকাল বোঝায়। নি বা না নাবাচক উপসর্গ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন: নিকৃষ্ট, নির্দয়, নিবাস, নিখাত, নিখুঁত, নিখোঁজ, নিমগ্ন, নিপুণ, নিবিড়, নিস্তব্ধ, নিপাতন, নির্বোধ, নির্লজ্জ, নিপাত, নারাজ, নাচার, নাখোশ, নালায়েক, নাপাক, নাবালক ইত্যাদি।
ন-এর সঠিক ব্যবহার -
১. তদ্ভব শব্দে ‘ন’ ব্যবহৃত হয়। যেমন: সোনা, কান, পান, নুন, ঘেন্না।
২. ত-বর্গীয় (ত, থ দ, ধ, ন) শব্দে ‘ন’ বসে। যেমন: অন্ত , অন্ন, অন্ধ, ছন্দ, পন্থা।
৩. ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড) বাদে অন্যান্য যুক্তবর্ণে ‘ন’ বসে। যেমন: অগ্নি, জন্ম, রতœ, স্নেহ, প্রশ্ন।
৪. ক্রিয়াপদে সব সময় ‘ন’ বসে। যেমন: খান, করেন, মরেন, পাঠান।
৫. বিদেশি শব্দে ‘ন’ বসে। যেমন: গ্রিন, ইস্টার্ন, কেরানি, হর্ন, কুরআন।
৬. সাধিত শব্দে ‘ন’ বসে। যেমন: সর্বনাম, নির্গমন, নিস্পন্ন, অহর্নিশ।
৭. শব্দের শুরুতে ‘ন’ বসে (ণত্ব, ণিজন্ত বাদে)। যেমন: নয়ন, নায়ক, নাক।
৮. ‘ণ’ বর্ণের পর ‘ন’ বসে। যেমন: গণনা, বর্ণনা, পাণিনি।
৯. সময়ে ‘ন’ বসে। যেমন : মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন।
১৯. ষ/স/শ-এর বানান /ষত্ববিধান
শ/স/ষ-এর সঠিক ব্যবহারকে ষত্ববিধান বলে। যেমন:
১. ঋ/ঋ-কারের পর সংস্কৃত শব্দে ‘ষ’ বসে। যেমন: ঋষভ, ঋষি, কৃষি, কৃষক, বৃষ্টি, তৃষ্ণা।
২. রেফ-এর পর ‘ষ’ বসে। যেমন: কর্ষ, বর্ষ, হর্ষ, বার্ষিক। নিষ্পাপ, নিষ্ফল, নিষ্পন্ন, নিষ্কৃতি।
৩. ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড) সংস্কৃত শব্দে ‘ষ’ বসে। যেমন: অষ্ট, কষ্ট, ষষ্ঠ, রুষ্ট, সৃষ্টি।
৪. অধি/অনু/অভি/ পরি/প্রতি/বি/সু যুক্ত উপসর্গে ‘ষ’ বসে। যেমন: অনুষঙ্গ, পরিষদ, পরিষ্কার, প্রতিষেধক, প্রতিষ্ঠান, বিষণ্ন, সুষম।
৫. ‘নিঃ’ ও ‘দুঃ’ উপসর্গে গঠিত শব্দে ‘ষ’ বসে অর্থাৎ নিষ ও দুষ যুক্ত শব্দে ‘ষ’ বসে। যেমন: নিষেধ, নিষ্পন্ন, দুষ্প্রাপ্য, দুষ্কর, দুষ্কৃতি।
৬. বিশেষ্য হলে ‘শ’ আর বিশেষণ হলে ‘ষ’ বসে। যেমন: আদেশ-আদিষ্ট, আবেশ-আবিষ্ট, ক্লেশ-ক্লিষ্ট, নির্দেশ-নির্দিষ্ট, প্রবেশ-প্রবিষ্ট, বিনাশ -বিনষ্ট।
৭. সন্ধি বা বিসর্গ সন্ধিতে ‘স’ বসে। সাৎ প্রত্যয়যুক্ত শব্দে স বসে। যেমন: তিরস্কার, পুরস্কার, ভাস্কর, বৃহস্পতি, আকসাৎ।
৮. বিদেশি শব্দে ‘শ’ বা ‘স’ বসে। চ-বর্গীয় শব্দে ‘শ’ বসে। ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড)  বিদেশি শব্দে স বসে। যেমন: তামাশা, খুশি, মসজিদ, সালাম, আশ্চর্য, নিশ্চয়, পশ্চিম, আগস্ট, মাস্টার, স্টোর, পোস্টার, স্কুল।
৯. বিদেশি শব্দে ‘স/শ’ বসে (‘ছ/ষ’ বসে না) ঝ, s>স, স্ট /sh>শ। যেমন: আর্টিস্ট, টুরিস্ট, টেস্ট, টোস্ট, টেস্টি, ডাস্টবিন, মাস্টার, পোস্টার, ফাস্ট, ব্রেকফাস্ট, রেজিস্ট্রার, স্কুল, স্টল, স্টপ, স্টেশন, স্টুডিও পেস্ট, স্টোর, স্ট্রিট, স্টেডিয়াম, স্টিকার, সিলেবাস, হোস্টেল, স্টেশন, সেশন, শিপ, ব্রিটিশ, মেশিন, কমিশন।

Monday, 18 April 2016

সহজ বাংলা বানান নিয়ম

১. দূরত্ব বোঝায় না এরূপ শব্দে উ-কার যোগে ‘দুর’ (‘দুর’ উপসর্গ) বা ‘দু+রেফ’ হবে। যেমন— দুরবস্থা, দুরন্ত, দুরাকাঙ্ক্ষা, দুরারোগ্য, দুরূহ, দুর্গা, দুর্গতি, দুর্গ, দুর্দান্ত, দুর্নীতি, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, দুর্নাম, দুর্ভোগ, দুর্দিন, দুর্বল, দুর্জয় ইত্যাদি।
২. দূরত্ব বোঝায় এমন শব্দে ঊ-কার যোগে ‘দূর’ হবে। যেমন— দূর, দূরবর্তী, দূর-দূরান্ত, দূরীকরণ, অদূর, দূরত্ব, দূরবীক্ষণ ইত্যাদি।
৩. পদের শেষে ‘-জীবী’ ঈ-কার হবে। যেমন— চাকরিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, আইনজীবী ইত্যাদি।
৪. পদের শেষে ‘-বলি’ (আবলি) ই-কার হবে। যেমন— কার্যাবলি, শর্তাবলি, ব্যাখ্যাবলি, নিয়মাবলি, তথ্যাবলি ইত্যাদি।
৫. ‘স্ট’ এবং ‘ষ্ট’ ব্যবহার: বিদেশি শব্দে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে। বিশেষ করে ইংরেজি st যোগে শব্দগুলোতে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে। যেমন— পোস্ট, স্টার, স্টাফ, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, স্ট্যাটাস, মাস্টার, ডাস্টার, পোস্টার, স্টুডিও, ফাস্ট, লাস্ট, বেস্ট ইত্যাদি। ষত্ব-বিধান অনুযায়ী বাংলা বানানে ট-বর্গীয় বর্ণে ‘ষ্ট’ ব্যবহার হবে। যেমন— বৃষ্টি, কৃষ্টি, সৃষ্টি, দৃষ্টি, মিষ্টি, নষ্ট, কষ্ট, তুষ্ট, সন্তুষ্ট ইত্যাদি।
৬. ‘পূর্ণ’ এবং ‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/পুনরায়) ব্যবহার : ‘পূর্ণ’ (ইংরেজিতে Full/Complete অর্থে) শব্দটিতে ঊ-কার এবং র্ণ যোগে ব্যবহার হবে। যেমন— পূর্ণরূপ, পূর্ণমান, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ ইত্যাদি। ‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/পুনরায়— ইংরেজিতে Re- অর্থে) শব্দটিতে উ-কার হবে এবং অন্য শব্দটির সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবহার হবে। যেমন— পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পুনঃপুন, পুনর্জীবিত, পুনর্নিয়োগ, পুনর্নির্মাণ, পুনর্মিলন, পুনর্লাভ, পুনর্মুদ্রিত, পুনরুদ্ধার, পুনর্বিচার, পুনর্বিবেচনা, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ইত্যাদি।
৭. পদের শেষে’-গ্রস্থ’ নয় ‘-গ্রস্ত’ হবে। যেমন— বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত ইত্যাদি।
৮. অঞ্জলি দ্বারা গঠিত সকল শব্দে ই-কার হবে। যেমন— অঞ্জলি, গীতাঞ্জলি, শ্রদ্ধাঞ্জলি ইত্যাদি।
৯. ‘কে’ এবং ‘-কে’ ব্যবহার: প্রশ্নবোধক অর্থে ‘কে’ (ইংরেজিতে Who অর্থে) আলাদা ব্যবহার হয়। যেমন— হৃদয় কে? প্রশ্ন করা বোঝায় না এমন শব্দে ‘-কে’ এক সাথে ব্যবহার হবে। যেমন— হৃদয়কে আসতে বলো।
১০. বিদেশি শব্দে ণ, ছ, ষ ব্যবহার হবে না। যেমন— হর্ন, কর্নার, সমিল (করাতকল), স্টার, আস্‌সালামু আলাইকুম, ইনসান, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি।
১১. অ্যা, এ ব্যবহার: বিদেশি বাঁকা শব্দের উচ্চারণে ‘অ্যা’ ব্যবহার হয়। যেমন— অ্যান্ড (And), অ্যাড (Ad/Add), অ্যাকাউন্ট (Account), অ্যাম্বুলেন্স (Ambulance), অ্যাসিস্ট্যান্ট (Assistant), অ্যাডভোকেট (Advocate), অ্যাকাডেমিক (Academic), অ্যাডভোকেসি (Advocacy) ইত্যাদি। অবিকৃত বা সরলভাবে উচ্চারণে ‘এ’ হয়। যেমন— এন্টার (Enter), এন্ড (End), এডিট (Edit) ইত্যাদি।
১২. ইংরেজি বর্ণ S-এর বাংলা প্রতিবর্ণ হবে ‘স’ এবং sh, -sion, -tion শব্দগুচ্ছে ‘শ’ হবে। যেমন— সিট (Seat/Sit), শিট, (Sheet), রেজিস্ট্রেশন (Registration), মিশন (Mission) ইত্যাদি।
১৩. আরবি বর্ণ ش (শিন)-এর বাংলা বর্ণ রূপ হবে ‘শ’ এবং ث (সা), س (সিন) ও ص (সোয়াদ)-এর বাংলা বর্ণ রূপ হবে ‘স’। ث (সা), س (সিন) ও ص (সোয়াদ)-এর উচ্চারিত রূপ মূল শব্দের মতো হবে এবং বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ‘স’ ব্যবহার হবে। যেমন— সালাম, শাহাদত, শামস্‌, ইনসান ইত্যাদি। আরবি, ফারসি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা থেকে আগত শব্দসমূহে ছ, ণ ও ষ ব্যবহার হবে না।
১৪. শ ষ স :
তৎসম শব্দে ষ ব্যবহার হবে। খাঁটি বাংলা ও বিদেশি শব্দে ষ ব্যবহার হবে না। বাংলা বানানে ‘ষ’ ব্যবহারের জন্য অবশ্যই ষত্ব-বিধান, উপসর্গ, সন্ধি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বাংলায় অধিকাংশ শব্দের উচ্চারণে ‘শ’ বিদ্যমান। এমনকি ‘স’ দিয়ে গঠিত শব্দেও ‘শ’ উচ্চারণ হয়। ‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ বাংলায় খুবই কম। ‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে— সমীর, সাফ, সাফাই। যুক্ত বর্ণ, ঋ-কার ও র-ফলা যোগে যুক্তধ্বনিতে ‘স’-এর উচ্চারণ পাওয়া যায়। যেমন— সৃষ্টি, স্মৃতি, স্পর্শ, স্রোত, শ্রী, আশ্রম ইত্যাদি।
১৫. সমাসবদ্ধ পদ ও বহুবচন রূপী শব্দগুলোর মাঝে ফাঁক রাখা যাবে না। যেমন— চিঠিপত্র, আবেদনপত্র, ছাড়পত্র (পত্র), বিপদগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত (গ্রস্ত), গ্রামগুলি/গ্রামগুলো (গুলি/গুলো), রচনামূলক (মূলক), সেবাসমূহ (সমূহ), যত্নসহ, পরিমাপসহ (সহ), ত্রুটিজনিত, (জনিত), আশঙ্কাজনক, বিপজ্জনক (জনক), অনুগ্রহপূর্বক, উল্লেখপূর্বক (পূর্বক), প্রতিষ্ঠানভুক্ত, এমপিওভুক্ত, এমপিওভুক্তি (ভুক্ত/ভুক্তি), গ্রামভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক, রোলভিত্তিক (ভিত্তিক), অন্তর্ভুক্তকারণ, এমপিওভুক্তকরণ, প্রতিবর্ণীকরণ (করণ), আমদানিকারক, রফতানিকারক (কারক), কষ্টদায়ক, আরামদায়ক (দায়ক), স্ত্রীবাচক (বাচক), দেশবাসী, গ্রামবাসী, এলাকাবাসী (বাসী), সুন্দরভাবে, ভালোভাবে (ভাবে), চাকরিজীবী, শ্রমজীবী (জীবী), সদস্যগণ (গণ), সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী (কারী), সন্ধ্যাকালীন, শীতকালীন (কালীন), জ্ঞানহীন (হীন), দিনব্যাপী, মাসব্যাপী, বছরব্যাপী (ব্যাপী) ইত্যাদি। এ ছাড়া যথাবিহিত, যথাসময়, যথাযথ, যথাক্রমে, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহিঃপ্রকাশ শব্দগুলো একত্রে ব্যবহার হয়।
১৬. বিদেশি শব্দে ই-কার ব্যবহার হবে। যেমন— আইসক্রিম, স্টিমার, জানুয়ারি, ফ্রেরুয়ারি, ডিগ্রি, চিফ, শিট, শিপ, নমিনি, কিডনি, ফ্রি, ফি, ফিস, স্কিন, স্ক্রিন, স্কলারশিপ, পার্টনারশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, স্টেশনারি, নোটারি, লটারি, সেক্রেটারি, টেরিটরি, ক্যাটাগরি, ট্রেজারি, ব্রিজ, প্রাইমারি, মার্কশিট, গ্রেডশিট ইত্যাদি।
১৭. উঁয়ো (ঙ) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ। এক্ষেত্রে অনুস্বার (ং) ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— অঙ্ক, অঙ্কন, অঙ্কিত, অঙ্কুর, অঙ্গ, অঙ্গন, আকাঙ্ক্ষা, আঙ্গুল/আঙুল, আশঙ্কা, ইঙ্গিত, উলঙ্গ, কঙ্কর, কঙ্কাল, গঙ্গা, চোঙ্গা/চোঙা, টাঙ্গা, ঠোঙ্গা/ঠোঙা, দাঙ্গা, পঙ্‌ক্তি, পঙ্কজ, পতঙ্গ, প্রাঙ্গণ, প্রসঙ্গ, বঙ্গ, বাঙালি/বাঙ্গালি, ভঙ্গ, ভঙ্গুর, ভাঙ্গা/ভাঙা, মঙ্গল, রঙ্গিন/রঙিন, লঙ্কা, লঙ্গরখানা, লঙ্ঘন, লিঙ্গ, শঙ্কা, শঙ্ক, শঙ্খ, শশাঙ্ক, শৃঙ্খল, শৃঙ্গ, সঙ্গ, সঙ্গী, সঙ্ঘাত, সঙ্গে, হাঙ্গামা, হুঙ্কার।
১৮. অনুস্বার (ং) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ। এক্ষেত্রে উঁয়ো (ঙ) ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— কিংবদন্তী, সংজ্ঞা, সংক্রামণ, সংক্রান্ত, সংক্ষিপ্ত, সংখ্যা, সংগঠন, সংগ্রাম, সংগ্রহ, সংগৃহীত।
[দ্রষ্টব্য: বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি অনুস্বার (ং) দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।]
১৯. ‘কোণ, কোন ও কোনো’-এর ব্যবহার:
কোণ : ইংরেজিতে Angle/Corner (∠) অর্থে।
কোন : উচ্চারণ হবে কোন্। বিশেষত প্রশ্নবোধক অর্থে ব্যবহার করা হয়। যেমন— তুমি কোন দিকে যাবে?
কোনো : ও-কার যোগে উচ্চারণ হবে। যেমন— যেকোনো একটি প্রশ্নের উত্তর দাও।
২০. বাংলা ভাষায় চন্দ্রবিন্দু একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ। চন্দ্রবিন্দু যোগে শব্দগুলোতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করতে হবে; না করলে ভুল হবে। অনেক ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার না করলে শব্দে অর্থের পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়া চন্দ্রবিন্দু সম্মানসূচক বর্ণ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যেমন— তাহাকে>তাঁহাকে, তাকে>তাঁকে ইত্যাদি।
২১. ও-কার: অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়া পদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ও-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব সৃষ্টি হতে পারে এমন শব্দে ও-কার ব্যবহার হবে। যেমন— মতো, হতো, হলো, কেনো (ক্রয় করো), ভালো, কালো, আলো ইত্যাদি। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ও-কার ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— ছিল, করল, যেন, কেন (কী জন্য), আছ, হইল, রইল, গেল, শত, যত, তত, কত, এত ইত্যাদি।
২২. বিশেষণবাচক আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন— সোনালি, রুপালি, বর্ণালি, হেঁয়ালি, খেয়ালি, মিতালি ইত্যাদি।
২৩. জীব, -জীবী, জীবিত, জীবিকা ব্যবহার। যেমন— সজীব, রাজীব, নির্জীব, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, জীবিত, জীবিকা।
২৪. অদ্ভুত, ভুতুড়ে বানানে উ-কার হবে। এ ছাড়া সকল ভূতে ঊ-কার হবে। যেমন— ভূত, ভস্মীভূত, বহির্ভূত, ভূতপূর্ব ইত্যাদি।
২৫. হীরা ও নীল অর্থে সকল বানানে ঈ-কার হবে। যেমন— হীরা, হীরক, নীল, সুনীল, নীলক, নীলিমা ইত্যাদি।
২৬. নঞর্থক পদগুলো (নাই, নেই, না, নি) আলাদা করে লিখতে হবে। যেমন— বলে নাই, বলে নি, আমার ভয় নাই, আমার ভয় নেই, হবে না, যাবে না।
২৭. অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে ই-কার ব্যবহার হবে। যেমন— সরকারি, তরকারি, গাড়ি, বাড়ি, দাড়ি, শাড়ি, চুরি, চাকরি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বেআইনি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, নিচু।
২৮. ত্ব, তা, নী, ণী, সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব শব্দের শেষে যোগ হলে ই-কার হবে। যেমন— দায়িত্ব (দায়ী), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (প্রতিদ্বন্দ্বী), প্রার্থিতা (প্রার্থী), দুঃখিনী (দুঃখী), অধিকারিণী (অধিকারী), সহযোগিতা (সহযোগী), মন্ত্রিত্ব, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ (মন্ত্রী), প্রাণিবিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ব, প্রাণিজগৎ, প্রাণিসম্পদ (প্রাণী) ইত্যাদি।
২৯. ঈ, ঈয়, অনীয় প্রত্যয় যোগ ঈ-কার হবে। যেমন— জাতীয় (জাতি), দেশীয় (দেশি ), পানীয় (পানি), জলীয়, স্থানীয়, স্মরণীয়, বরণীয়, গোপনীয়, ভারতীয়, মাননীয়, বায়বীয়, প্রয়োজনীয়, পালনীয়, তুলনীয়, শোচনীয়, রাজকীয়, লক্ষণীয়, করণীয়।
৩০. রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না৷ যেমন— অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য৷
৩১. ভাষা ও জাতিতে ই-কার হবে। যেমন— বাঙালি/বাঙ্গালি, জাপানি, ইংরেজি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি।
৩২. ব্যক্তির ‘-কারী’-তে (আরী) ঈ-কার হবে। যেমন— সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী, পথচারী, কর্মচারী ইত্যাদি। ব্যক্তির ‘-কারী’ নয়, এমন শব্দে ই-কার হবে। যেমন— সরকারি, দরকারি ইত্যাদি।
৩৩. প্রমিত বানানে শব্দের শেষে ঈ-কার থাকলে –গণ যোগে ই-কার হয়। যেমন— সহকারী>সহকারিগণ, কর্মচারী>কর্মচারিগণ, কর্মী>কর্মিগণ, আবেদনকারী>আবেদনকারিগণ ইত্যাদি।
৩৪. ‘বেশি’ এবং ‘-বেশী’ ব্যবহার: ‘বহু’, ‘অনেক’ অর্থে ব্যবহার হবে ‘বেশি’। শব্দের শেষে যেমন— ছদ্মবেশী, প্রতিবেশী অর্থে ‘-বেশী’ ব্যবহার হবে।
৩৫. ‘ৎ’-এর সাথে স্বরচিহ্ন যোগ হলে ‘ত’ হবে। যেমন— জগৎ>জগতে জাগতিক, বিদ্যুৎ>বিদ্যুতে বৈদ্যুতিক, ভবিষ্যৎ>ভবিষ্যতে, আত্মসাৎ>আত্মসাতে, সাক্ষাৎ>সাক্ষাতে ইত্যাদি।
৩৬. ইক প্রত্যয় যুক্ত হলে যদি শব্দের প্রথমে অ-কার থাকে তা পরিবর্তন হয়ে আ-কার হবে। যেমন— অঙ্গ>আঙ্গিক, বর্ষ>বার্ষিক, পরস্পর>পারস্পরিক, সংস্কৃত>সাংস্কৃতিক, অর্থ>আর্থিক, পরলোক>পারলৌকিক, প্রকৃত>প্রাকৃতিক, প্রসঙ্গ>প্রাসঙ্গিক, সংসার>সাংসারিক, সপ্তাহ>সাপ্তাহিক, সময়>সাময়িক, সংবাদ>সাংবাদিক, প্রদেশ>প্রাদেশিক, সম্প্রদায়>সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি।
৩৭. সাধু থেকে চলিত রূপের শব্দসমূহ যথাক্রমে দেখানো হলো: আঙ্গিনা>আঙিনা, আঙ্গুল>আঙুল, ভাঙ্গা>ভাঙা, রাঙ্গা>রাঙা, রঙ্গিন>রঙিন, বাঙ্গালি>বাঙালি, লাঙ্গল>লাঙল, হউক>হোক, যাউক>যাক, থাউক>থাক, লিখ>লেখ, গুলি>গুলো, শুন>শোন, শুকনা>শুকনো, ভিজা>ভেজা, ভিতর>ভেতর, দিয়া>দিয়ে, গিয়া>গিয়ে, হইল>হলো, হইত>হতো, খাইয়া>খেয়ে, থাকিয়া>থেকে, উল্টা>উল্টো, বুঝা>বোঝা, পূজা>পুজো, বুড়া>বুড়ো, সুতা>সুতো, তুলা>তুলো, নাই>নেই, নহে>নয়, নিয়া>নিয়ে, ইচ্ছা>ইচ্ছে ইত্যাদি।
৩৮. হয়তো, নয়তো বাদে সকল তো আলাদা হবে। যেমন— আমি তো যাই নি, সে তো আসে নি ইত্যাদি।
[দ্রষ্টব্য: মূল শব্দের শেষে আলাদা তো ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে।]
৩৯. ঙ, ঞ, ণ, ন, ং বর্ণের পূর্বে ঁ হবে না। যেমন— খান (খাঁ), চান, চন্দ (চাঁদ), পঞ্চ, পঞ্চাশ (পাঁচ) ইত্যাদি।
৪০. -এর, -এ ব্যবহার:
=> চিহ্নিত শব্দ/বাক্য বা উক্তির সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— গুলিস্তান ‘ভাসানী হকি ষ্টেডিয়াম’-এর সাইনবোর্ডে স্টেডিয়াম বানানটি ভুল।
=> শব্দের পরে যেকোনো প্রতীকের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— বিসর্গ (ঃ )-এর সঙ্গে স্বরধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির যে সন্ধি হয়, তাকে বিসর্গসন্ধি বলে।
=> বিদেশি শব্দ অর্থাৎ বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ নয় এমন শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— SMS-এর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে।
=> গাণিতিক শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— ৫-এর চেয়ে ২ কম।
=> সংক্ষিপ্ত শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ। যেমন— অ্যাগ্রো কোম্পানি লি.-এর সাথে চুক্তি।
এ ছাড়া পৃথক রূপে ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— বাংলাদেশ-এর না লিখে বাংলাদেশের, কোম্পানি-এর না লিখে কোম্পানির, শিক্ষক-এর না লিখে শিক্ষকের, স্টেডিয়াম-এ না লিখে স্টেডিয়ামে, অফিস-এ না লিখে অফিসে লিখতে হবে।
৪১. বিসর্গ (ঃ ) ব্যবহার:
বিসর্গ একটি বাংলা বর্ণ— এটি কোনো চিহ্ন নয়। বর্ণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বিসর্গ (ঃ) হলো অঘোষ ‘হ্‌’-এর উচ্চারণে প্রাপ্ত ধ্বনি। ‘হ’-এর উচ্চারণ ঘোষ কিন্তু বিসর্গ (ঃ)-এর উচ্চারণ অঘোষ। বাংলায় ভাষায় বিস্ময়াদি প্রকাশে বিসর্গ (ঃ )-এর উচ্চারণ প্রকাশ পায়। যেমন— আঃ, উঃ, ওঃ, ছিঃ, বাঃ । পদের শেষে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার হবে না। যেমন— ধর্মত, কার্যত, আইনত, ন্যায়ত, করত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ ইত্যাদি। পদমধ্যস্থে বিসর্গ ব্যবহার হবে। যেমন— অতঃপর, দুঃখ, স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তঃস্থল, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। অর্ধ শব্দকে পূর্ণতা দানে অর্থাৎ পূর্ণ শব্দকে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশে বিসর্গ ব্যবহার করা হলেও আধুনিক বানানে ডট ( . ) ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন— ডাক্তার>ডা. (ডাঃ), ডক্টর>ড. (ডঃ), লিমিটেড> লি. (লিঃ) ইত্যাদি। বিসর্গ যেহেতু বাংলা বর্ণ এবং এর নিজস্ব ব্যবহার বিধি আছে— তাই এ ধরনের বানানে (ডাক্তার>ডা., ডক্টর>ড., লিমিটেড> লি.) বিসর্গ ব্যবহার বর্জন করা হয়েছে। কারণ বিসর্গ যতিচিহ্ন নয়।
[সতর্কীকরণ: বিসর্গ (ঃ)-এর স্থলে কোলন ( : ) কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— অত:পর, দু:খ ইত্যাদি। কারণ কোলন ( : ) কোনো বর্ণ নয়, চিহ্ন। যতিচিহ্ন হিসেবে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার যাবে না। যেমন— নামঃ রেজা, থানাঃ লাকসাম, জেলাঃ কুমিল্লা, ১ঃ৯ ইত্যাদি।]
বিসর্গসন্ধি:
বিসর্গ (ঃ )-এর সঙ্গে স্বরধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির যে সন্ধি হয়, তাকে বিসর্গসন্ধি বলে। উচ্চারণের দিক থেকে বিসর্গ দু রকম :
১. র্ -জাত বিসর্গ : শব্দের শেষে র্ থাকলে উচ্চারণের সময় র্ লোপ পায় এবং র্-এর জায়গায় বিসর্গ (ঃ) হয়। উচ্চারণে র্ বজায় থাকে। যেমন— অন্তর>অন্তঃ+গত=অন্তর্গত ( অন্‌তোর্‌গতো)।
২. স্-জাত বিসর্গ : শব্দের শেষে স্ থাকলে সন্ধির সময় স্ লোপ পায় এবং স্-এর জায়গায় বিসর্গ ( ঃ ) হয়। উচ্চারণে স্ বজায় থাকে। যেমন : নমস্ > নমঃ + কার = নমস্কার ( নমোশ্‌কার্‌)।
বিসর্গসন্ধি দু-ভাবে সাধিত হয় : ১. বিসর্গ ( ঃ ) ও স্বরধ্বনি মিলে; ২. বিসর্গ ( ঃ ) ও ব্যঞ্জনধ্বনি মিলে।
১. বিসর্গ ও স্বরধ্বনির সন্ধি:
ক. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে অ-ধ্বনি থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি স্থলে ও-কার হয়। যেমন—
ততঃ + অধিক = ততোধিক
যশঃ + অভিলাষ = যশোভিলাষ
বয়ঃ + অধিক = বয়োধিক
খ. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে অ, আ, উ-ধ্বনি থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি মিলে র হয়। যেমন—
পুনঃ + অধিকার = পুনরধিকার
প্রাতঃ + আশ = প্রাতরাশ
পুনঃ + আবৃত্তি = পুনরাবৃত্তি
পুনঃ + উক্ত = পুনরুক্ত
২. বিসর্গ ও ব্যঞ্জনধ্বনির সন্ধি
ক. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে বর্গের ৩য়/ ৪র্থ/ ৫ম ধ্বনি অথবা য, র, ল, হ থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি স্থলে র-জাত বিসর্গে র/ রেফ (র্) এবং স-জাত বিসর্গে ও-কার হয়। যেমন—
র-জাত বিসর্গ : র্
অন্তঃ + গত = অন্তর্গত
পুনঃ + জন্ম = পুনর্জন্ম
অন্তঃ + ধান = অন্তর্ধান
পুনঃ + বার = পুনর্বার
অন্তঃ + ভুক্ত = অন্তর্ভুক্ত
পুনঃ + মিলন = পুনর্মিলন
স-জাত বিসর্গ : ও
মনঃ + গত = মনোগত
সদ্যঃ + জাত = সদ্যোজাত
তিরঃ + ধান = তিরোধান
তপঃ + বন = তপোবন
অধঃ + মুখ = অধোমুখ
মনঃ + যোগ = মনোযোগ
মনঃ + রম = মনোরম
মনঃ + লোভা = মনোলোভা
মনঃ + হর = মনোহর
খ. বিসর্গের পরে চ/ছ থাকলে বিসর্গের স্থলে শ; ট/ঠ থাকলে ষ এবং ত/থ থাকলে স হয়। যেমন—
নিঃ + চয় = নিশ্চয়
দুঃ + চরিত্র = দুশ্চরিত্র
ধনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার
নিঃ + ঠুর = নিষ্ঠুর
চতুঃ + টয় = চতুষ্টয়
দুঃ + তর = দুস্তর
নিঃ + তেজ = নিস্তেজ
ইতঃ + তত = ইতস্তত
দুঃ + থ = দুস্থ
গ. অ/আ ভিন্ন অন্য স্বরের সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে স্বরধ্বনি, বর্গের ৩য় / ৪র্থ / ৫ম ধ্বনি অথবা য, র, ল, হ থাকলে বিসর্গ স্থলে র হয়। যেমন—
নিঃ + অবধি = নিরবধি
নিঃ + আপদ = নিরাপদ
নিঃ + গত = নির্গত
নিঃ + ঘণ্ট = নির্ঘণ্ট
নিঃ + বাক = নির্বাক
নিঃ + ভয় = নির্ভয়
আবিঃ + ভাব = আবির্ভাব
আশীঃ + বাদ = আশীর্বাদ
দুঃ + অবস্থা = দুরবস্থা
দুঃ + আচার = দুরাচার
দুঃ + গতি = দুর্গতি
দুঃ + বোধ = দুর্বোধ
প্রাদুঃ + ভাব = প্রাদুর্ভাব
দুঃ + মর = দুর্মর
দুঃ + যোগ = দুর্যোগ
দুঃ + লভ = দুর্লভ
ঘ. র-জাত বিসর্গের পরে র থাকলে বিসর্গ লোপ পায় এবং প্রথমে ই-কার থাকলে তা ঈ-কার হয়। যেমন—
নিঃ + রব = নীরব
নিঃ + রস = নীরস
নিঃ + রোগ = নীরোগ
ঙ. অ/আ ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে ক, খ, প, ফ থাকলে বিসর্গ স্থলে স হয়। যেমন—
নমঃ + কার = নমস্কার
তিরঃ + কার = তিরস্কার
পুরঃ + কার = পুরস্কার
ভাঃ + কর = ভাস্কর
চ. ই/উ ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে ক, খ, প, ফ থাকলে বিসর্গ স্থলে ষ হয়। যেমন—
নিঃ + কাম = নিষ্কাম
নিঃ + পাপ = নিষ্পাপ
নিঃ + ফল = নিষ্ফল
বহিঃ + কার = বহিষ্কার
চতুঃ + পদ = চতুষ্পদ
চতুঃ + কোণ = চতুষ্কোণ
ছ. কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ধির বিসর্গ লোপ পায় না। যেমন—
প্রাতঃ + কাল = প্রাতঃকাল
মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট
শিরঃ + পীড়া = শিরঃপীড়া
অন্তঃ + করণ = অন্তঃকরণ
৪২. ম-ফলা ও ব-ফলার উচ্চারণ:
ম-ফলার উচ্চারণ:
ক. পদের প্রমে ম-ফলা থাকলে সে বর্ণের উচ্চারণে কিছুটা ঝোঁক পড়ে এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন— শ্মশান ( শঁশান্), স্মরণ (শঁরোন্)।
কখনো কখনো ‘ম’ অনুচ্চারিত থাকতে ও পারে। যেমন— স্মৃতি (সৃতি বা সৃঁতি)।
খ. পদের মধ্যে বা শেষে ম-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে সে বর্ণের দ্বিত্ব হয় এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন— আত্মীয় (আত্‌তিঁয়), পদ্ম (পদ্‌দোঁ), বিস্ময় (বিশ্‌শঁয়), ভস্মস্তূপ (ভশ্‌শোঁস্‌তুপ্‌), ভস্ম (ভশ্‌শোঁ), রশ্মি (রোশ্‌শিঁ)।
গ. গ, ঙ, ট, ণ, ন, বা ল বর্ণের সঙ্গে ম-ফলা যুক্ত হলে, ম-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যুক্ত ব্যঞ্জনের প্রথম বর্ণের স্বর লুপ্ত হয়। যেমন— বাগ্মী (বাগ্‌মি), যুগ্ম (যুগ্‌মো), মৃন্ময় (মৃন্‌ময়), জন্ম (জন্‌মো), গুল্ম (গুল্‌মো)।
ব-ফলার উচ্চারণ:
ক. শব্দের প্রমে ব-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে শুধু সে বর্ণের উপর অতিরিক্ত ঝোঁক পড়ে। যেমন— ক্বচিৎ (কোচিৎ), দ্বিত্ব (দিত্‌তো), শ্বাস (শাশ্), স্বজন (শজোন), দ্বন্দ্ব (দন্‌দো)।
খ. শব্দের মধ্যে বা শেষে ব-ফলা যুক্ত হলে যুক্ত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন— বিশ্বাস (বিশ্‌শাশ্), পক্ব (পক্‌কো), অশ্ব (অশ্‌শো)।
গ. সন্ধিজাত শব্দে যুক্ত ব-ফলায় ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— দিগ্বিজয় (দিগ্‌বিজয়), দিগ্বলয় (দিগ্‌বলয়)।
ঘ. শব্দের মধ্যে বা শেষে ‘ব’ বা ‘ম’-এর সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— তিব্বত (তিব্‌বত). লম্ব (লম্‌বো)।
ঙ. উৎ উপসর্গের সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বহাল থাকে। যেমন— উদ্বাস্তু (উদ্‌বাস্‌তু), উদ্বেল (উদ্‌বেল্‌)।
[দ্রষ্টব্য: আমাদের অবশ্যই বাংলা বানান ও বাংলা বানানের উচ্চারণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কারণ বাংলা বানান ও উচ্চারণের পার্থক্য রয়েছে। যেমন— আছ (আছো), দেখা (দ্যাখা), একা (অ্যাকা) ইত্যাদি।]